প্রবাদ আছে যে, ‘যার কোনো কাজ নেই, সে নাকি তীরে বসে সাগরের ঢেউ গুনে যায়।’ সাগরের ঢেউ গোনা নাকি কর্মহীনতারই এক লক্ষণ। কিন্তু সত্যিই কী তাই? সাগরের ঢেউ পর্যবেক্ষণ করা ও সেই ঢেউকে কার্যকরী করে তোলা কি বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই ব্যাপারে দীর্ঘকাল বহু বিজ্ঞানী ভাবনাচিন্তা করেছেন এবং যথেস্ট ফলপ্রসূ কাজও হয়েছে।
বর্তমান যুগে সারা বিশ্বে শক্তি ও তার উৎসের প্রবল চাহিদা ও অনটন। এই অভাব ও অনটনের মোকাবিলায় সারা বিশ্ব আজ বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে আগ্রহী। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যে উৎসের কথা মনে আসে, সেটি হল সমুদ্রের ‘তরঙ্গ’ বা ‘ঢেউয়ের শক্তি’। সমুদ্র বা সাগরের শক্তি অসীম এবং এই প্রভূত শক্তিসম্পদকে কি পৃথিবীর শক্তি চাহিদা পূরণে ব্যবহার করা যায় না? আমাদের এই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেই, তার বিশাল পরিমাণের সমুদ্রতটরেখা ও উত্তাল সমুদ্র, ভারতের শক্তিচাহিদার এক সফল সমাধান হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। এই উৎস শুধুমাত্র সহজলভ্যই নয় বরং এক বিশাল শক্তির অধিকারী। পৃথিবীর অন্যান্য কিছু উন্নতিশীল দেশের ক্ষেত্রে যারা এই বিশাল শক্তিভান্ডারকে সার্থকভাবে কাজে লাগিয়েছে, তাদের পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে, প্রাপ্ত শক্তি ও তাকে কার্যকরী শক্তিতে রূপান্তরিত করার অনুপাত বিশেষভাবে উৎসাহব্যঞ্জক।
ঢেউ থেকে শক্তি সংগ্রহের পদ্ধতিকে মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল যান্ত্রিক পদ্ধতি এবং দ্বিতীয়টি হল পয়োবাহী। প্রথম ক্ষেত্রে কিছু কাঠের ডুবুরি পাশাপাশি সাজিয়ে ঢেউয়ের পথে আড়াআড়িভাবে রাখা হয়, যেগুলো ঢেউয়ের আঘাতে সামনে-পিছনে নড়তে থাকে অথবা ভাসমান কাঠের ¯তূপ ঢেউয়ের আকারে সাজিয়ে পানির মধ্যে রাখা হয়। কাঠের ডুবুরির ক্ষেত্রে দোদুল্যমান গতিকে কার্যকরী শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং সেই শক্তিকে তীরবর্তী অঞ্চলে বিদ্যুৎশক্তি হিসাবে সঞ্চালিত করা যায়।
পক্ষান্তরে, কাঠের ¯তূপের ক্ষেত্রে তাদের পারস্পারিক গতির ফলে উদ্ভূত শক্তি, তাদের মধ্যে রাখা পয়োবাহী পাম্পের সাহায্যে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। এক্ষেত্রে ‘তরঙ্গ-সংশোধক এবং ‘কম্পমান পানিস্তর’ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। প্রথম পদ্ধতিতে এক বিশাল কাঠামো থাকে যার মধ্যে দুইটি পানিধার থাকে। এই দুইটি পানিধারের মধ্যে ‘ভালভ’ থাকে, যার মধ্য দিয়ে , ঢেউ যান্ত্রিক উপায়ে নিচের পানিধার থেকে উপরের পানিধারে পানিকে ঠেলে পাঠায়। এইভাবে দুই পানিধারের মধ্যে এক টার্বাইন চালানো সম্ভব হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, একই উপায়ে আগন্তুক ঢেউগুলো একটি উলটো করে রাখা পাত্রের মধ্যে পানির কম্পন সৃষ্টি করে এবং সেই পাত্র থেকে ওই কম্পনশক্তিজাত শক্তির সাহায্যে পানির বা বাতাস-টার্বাইন চালানো সম্ভব হয়।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঢেউয়ের শক্তিকে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা খুবই ফলুপ্রসূ। কিন্তু এই পদ্ধতির অসুবিধা হল এই যে, এই পদ্ধতি শুধুমাত্র সামান্য এক তরঙ্গ-কম্পাঙ্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই তরঙ্গ-গুচ্ছের মধ্যাকার তরঙ্গের বা ঢেউয়ের বিভিন্ন কম্পাঙ্কের হয় যা তীরে এসে আছড়ে পড়ে, তবে সর্বোচ্চ ঢেউ তীরে আছড়ে পড়তে দেখা যায় ১৫ সেকেন্ড অন্তর। অবশ্য এই মান সারাদিনব্যাপী একই থাকে না। সেজন্য যান্ত্রিক পদ্ধতিতে, মোট ঢেউয়ের শক্তির শুধুমাত্র কিছু অংশকে কার্যকরী শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। সংগ্রাহক ব্যবস্থাটিকেও আগন্তুক ঢেউয়ের কম্পাঙ্কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়। সেজন্য এই পদ্ধতির সাহায্যে শক্তি পেতে হলে, পরীক্ষাস্থানের ঢেউ সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন এবং ঢেউয়ের দিশা, গতিপথ ইত্যাদি সন্বন্ধেও সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যিক।
বায়ুশক্তির তুলনায় তরঙ্গশক্তিতে শক্তি যথেষ্ট ঘনীভূত থাকে। প্রকৃতপক্ষে সমুদ্র বা সাগর এক শক্তিশালী বায়ুশক্তি সংগ্রাহক। বায়ুশক্তিকে গ্রহণ করে বিশাল পানিস্তরে সাগর নিজবক্ষে ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। নীতিগতভাবে, ভারতবর্ষের তটদেশে সমুদ্র -ঢেউয়ের প্রতি মিটার দৈর্ঘ্য, গড়পড়তায় ৬০ কিলোওয়াট শক্তি সঞ্চিত থাকে। রূপান্তর ও পরিবহণজনিত ক্ষয় ও ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েও এই শক্তির পরিমাণ হবে, ঢেউয়ের প্রতি মিটার দৈর্ঘ্য ১০ কিলোওয়াট যা অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া শক্তির তুলনায় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যান্য উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের (পানিবিদ্যুৎ, তাপবিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ) ব্যয়ভারের তুলনায়, তরঙ্গ বা ঢেউজাত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় তেমন কিছু বেশিও নয়। আসল সমস্যাটি হল, ঢেউশক্তিকে যথাযথভাবে কার্যকরী করে তোলার ব্যবস্থা করা।
কারিগরি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক অসুবিধা যেমন-তটক্ষয় ইত্যাদি এই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা হিসাবে দেখা দিতে পারে। কিন্তু এইসব নানা অসুবিধা থাকা সত্তে¡ও (যান্ত্রিক ও আর্থিক) অদূর ভবিষ্যতে এই ঢেউয়ের শক্তি বা তরঙ্গশক্তি বাস্তব জীবনে এক বিকল্প শক্তির উৎস হিসাবে পরিগণিত হবে। এর কারণ ঢেউ আদি ও অনন্তকালব্যাপী বিরাজমান আছে ও থাকবে এবং এই অনন্ত উৎসের জন্য মানবসমাজকে ব্যয়ও করতে হবে না কিছুমাত্র।
সুতরাং, কোনও এক গোধূলিবেলায়, দিঘা বা পুরীর সমুদ্রতটে, দাঁড়িয়ে কেউ যদি আপন মনে সাগরের ঢেউ শুনে যান এবং সেই ঢেউ থেকে অফুরন্তন শক্তি সংগ্রহের কথা চিন্তা করেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে কি কেউ কর্মহীন ব্যক্তি বলে আখ্যা দেবেন?