বাংলাদেশে আম উৎপাদন: সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয়

ড. মো. গোলাম রাব্বানী
  ২৮ মে ২০২৪, ১২:৫৬

আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের মধ্যে আম সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু ফল, যা দেশের সব জেলায় চাষ হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষের জন্য দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সর্বাধিক বিখ্যাত। এছাড়া রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জেলাগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হয়। চাষাধীন মোট জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন এবং উৎপাদিত আমের গুণ ও মান বিবেচনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের ‘আমের রাজধানী’ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশে ২০২২-২০২৩ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৯৮ হেক্টর জমি থেকে ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৯৩৭ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয় এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ১১.৯৬ মেট্রিকটন (বিবিএস, ২০২৩)। অন্যদিকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, অর্থাৎ ২০০০-২০০১ সালে দেশে ৫০ হাজার ৬২৬ হেক্টর জমি থেকে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৮০ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস ২০০৫) এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ছিল ৩.৭৭ মেট্রিক টন। তথ্য পর্যালোনায় দেখা যায়, ২০০০-২০০১ সালের তুলনায় ২০২২-২০২৩ সালে, অর্থাৎ বিগত ২৩ বছরে দেশে আম চাষের জমির পরিমাণ ২.৪৫ গুণ, উৎপাদনের পরিমাণ ১১.৯৬ গুণ এবং হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৩.১৭ গুণ বেড়েছে। মোট আম উৎপাদন বিবেচনায় বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
আমের পুষ্টিমান ও ব্যবহার :স্বাদ-গন্ধ, পুষ্টিমান, রং ও বিচিত্র ব্যবহার বিচেনায় আম একটি জনপ্রিয় ও আদর্শ ফল। এ জন্য আম ‘ফলের রাজা’ নামে পরিচিত। আমে বিভিন্ন ধরনের ম্যাক্রো এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট রয়েছে। আমের প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য পাল্পে ৮৩.৪৬ গ্রাম পানি, ৬০ কিলোক্যালরি শক্তি, ১৪.৯৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.৮২ গ্রাম প্রোটিন, ০.৩৮ গ্রাম চর্বি, ১.৬ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.১৬ মিলিগ্রাম আয়রন, ১০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ১৬৮ ----- পটাশিয়ামসহ যথেষ্ট পরিমাণ জিংক, কপার ও সেলেনিয়াম, ৩৬.৪ গ্রাম ভিটামিন সি, ০.৮৯৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ২০০০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট ভিটামিন এ, ০.৯ গ্রাম ভিটামিন ই এবং ৪.২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে রয়েছে। অন্যদিকে প্রতি ১০০ গ্রাম আমের খোসায় ৭২.৫ গ্রাম পানি, ২৮.২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩.৬ গ্রাম প্রোটিন, ২.২ গ্রাম চর্বি, ২৫ গ্রাম সুগার, ৪০-৭২.৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ১৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪০.৬ মিলিগ্রাম আয়রন, ১০০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ৭৫ পটাশিয়ামসহ যথেষ্ট পরিমাণ জিংক ও কপার, ১৮-২৫৭ গ্রাম ভিটামিন সি, ০.৮৯৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ১০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ, ০.২৫-০.৫৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই রয়েছে।
এ ছাড়া আমের প্রতি ১০০ গ্রাম বীজপত্রে (কার্নেলে) ৯.১ গ্রাম পানি, ৩২৭ কিলোক্যালরি শক্তি, ১৮.২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬.৬১ গ্রাম প্রোটিন, ৯.৪ গ্রাম চর্বি, ৭০ গ্রাম সুগার, ২.৮ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ৪৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১১.৯ মিলিগ্রাম আয়রন, ১০০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ৩৬৫ পটাশিয়ামসহ, ১৪০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, যথেষ্ট পরিমাণ জিংক, ১৭.০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.৭১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ১৫ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট ভিটামিন এ, ১.৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই এবং ৫৯.০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে রয়েছে।
আম একটি বহুবিধ ব্যবহারযোগ্য গাছ। টাটকা ফল হিসেবে আম কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। কাঁচা ও পাকা আম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আচার, আমচুর, চাটনি, মোরব্বা, জুস, জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ, আমসত্ত্ব, লিকার, পাল্প, টফি, মধু, বরফি, পাউডারসহ নানাবিধ খাবার এবং পানীয় প্রস্তুত করা হয়। এই গাছের শিকড়, বাকল, কাঠ, পাতা, ফলসহ প্রতিটি অঙ্গ মানুষ বিভিন্ন কাজে যেমন—খাদ্য, জ্বালানি, আসবাবপত্র, বাসস্থান তৈরি, পশুখাদ্য, ওষুধপত্র তৈরিসহ নানানভাবে ব্যবহার করে। এছাড়া আম বৃক্ষজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ বিধায় এর কার্বন সংরক্ষণক্ষমতা বেশি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই গাছের পরিচিতি, ফলের জনপ্রিয়তা, দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুতপূর্ণ ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে ২০১০ সালে সরকার আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলাদেশে আম চাষের সমস্যা :মোট জমির পরিমাণ ও উৎপাদনের নিরিখে আম বাংলাদেশের ১ নম্বর ফল। এ দেশে আম উৎপাদনের জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন ও ফলন ক্রমান্বয়ে বাড়লেও উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি পর্যায়ে বিভিন্ন সম্যসার কারণে আমচাষি, ব্যবসায়ী ভোক্তা ও রপ্তানিকারকগণ এর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না। বিভিন্ন পর্যায়ে সমস্যা হলো, উন্নত জাতের অভাব; বহু ব্যবহারোপযোগী এবং বছরব্যাপী ফলদানকারী জাতের অভাব; মানসম্পন্ন উৎপাদন উপকরণের অভাব ও অধিক মূল্য; উন্নতমানের রোপণ দ্রব্যের অভাব; উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব; পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জ্ঞানের অভাব; পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধ বা প্রতিকারে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতি; পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য ব্যবহূত উপকরণের অতিরিক্ত মূল্য; ফল আহরণের উন্নত প্রযুক্তি এবং তা ব্যবহারের অভাব; ফল আহরণ-পরবর্তী প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান এবং তা ব্যবহারের অভাব; উৎপাদক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সাময়িক সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণগারের অভাব; পরিবেশদূষণ—বিশেষ করে আমবাগানের আশপাশে ইটভাটা এবং ধোয়া উৎপাদনকারী কলকারখানা স্থাপন; আম উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার; অপরিপক্ব আম আহরণ ও বাজারজাতকরণ; আম পাকানো ও সংরক্ষণে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার; বাগান থেকে বাজার পর্যন্ত পরিবহনব্যবস্থার অপ্রতুলতা; উৎপাদক পর্যায়ে দূরবর্তী মার্কেট ও পরিবহন সমস্যা; উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম প্যাকেজিংয়ের অনুপস্থিতি; উৎপাদক পর্যায়ে সঠিক মূল্য না পাওয়া বিশেষ করে উৎপাদন মৌসুমে অনুমোদিত বা অননুমোদিত আম আমদানির ফলে উৎপাদক পর্যায়ে সঠিক মূল্য না পাওয়া; আম পরিবহনে বৈজ্ঞানিক পরিবহনব্যবস্থার অনুপস্থিতি; স্থানীয় ও দূরবর্তী পাইকারি মার্কেট ও বিমানবন্দরে হিমাগারের অপ্রতুলতা; কৃষক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন ও বাজারজাতে সম্যক জ্ঞানের অভাব; রপ্তানিযোগ্য আমের কোয়ালিটি ও স্ট্যান্ডার্ড বিষয়ে কৃষক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের ধারণা না থাকা; আমদানিকারক দেশের আম আমদানি বিষয়ে বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে কৃষক, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের সম্যক ধারণার অভাব; বিদেশি আমদানিকারকদের আমাদের দেশ ও আম সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত না থাকা; ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট নিতে জটিলতা; উৎপাদক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আম উৎপাদন, সংগ্রহ, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থপনা ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণের অভাব; আম উৎপাদন ও ব্যবসায় সরকারি সহযোগিতা, নীতিমালা ও লোনের অপর্যাপ্ততা; উৎপাদক পর্যায়ে আমচাষিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভালের জন্য শক্তিশালী সংগঠনের অনুপস্থিতি; আম উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং তা মোকাবিলায় যথেষ্ট গবেষণা ও প্রযুক্তির অভাব; মাঠ পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিষয়ে গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি দেশব্যাপী আম উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, রপ্তানি বিষয়ে সমন্বিত গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির অভাব।
আম চাষের সম্ভবনা :আম আমাদের দেশীয় ফল। হাজার বছর ধরে এ দেশে আম চাষ হয়ে আসছে। তাই বাংলাদেশে আম চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা বাতুলতা মাত্র। বরং এ দেশে আম চাষ কেন জনপ্রিয়, তার পেছনেও নানা কারণ আছে। যেমন—উপযোগী মাটি ও জলবায়ু; আম এ দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় ফল; বিশাল স্থানীয় বাজার (প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাজার); খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; একক জমিতে অধিক খাদ্য ও পুষ্টি উৎপাদন; এককালীন পুঁজি বিনিয়োগে বেশি লাভ; আমের ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন স্তরে ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ; সস্তা শ্রম ও অন্যান্য উৎপাদন উপকরণ; স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আমের চাহিদা; প্রায় সারা বছর আম চাষে কর্মসংস্থানের সুযোগ; আম চাষের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠা যেমন—পাল্প, জুস তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ; গ্রাম পর্যায়ে আম থেকে জুস, জ্যাম, জেলি, আমচুর, আমসত্ত্ব ইত্যাদি তৈরির জন্য কুঠিরশিল্প প্রতিষ্ঠার সুযোগ; কুঠিরশিল্পে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা; বিদেশে আম ও আমজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়; ইকোট্যুরিজমের সুযোগ; আম থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য তৈরি ও ব্যবহারের সুযোগ; অনলাইনে আম ও আমজাত দ্রব্য বিপণনের মাধ্যমে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের কৃষি বর্তমানে চিরাচরিত কৃষিব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যিক কৃষিব্যবস্থায় রূপান্তরের পর্যায়ে রয়েছে। যে কোনো বাণিজ্যিক উৎপাদনব্যবস্থায় সমস্যা ও সম্ভাবনার অবস্থান পাশাপাশি। বাংলাদেশে আম উৎপাদনের বেলায়ও তা প্রযোজ্য। তবে সমস্যাসমূহের সমাধান করে এবং সম্ভাবনাসমূহকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম উৎপাদন দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক ও সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক :প্রফেসর, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ এবং ডিন, কৃষি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ