রবীন্দ্রনাথ একসময় লিখেছিলেন, 'মানুষ প্রাণের উপকরণ যদি মাটিতে ফিরিয়ে দেয় তবেই মাটির সঙ্গে তার প্রাণের কারবার ঠিকমতো চলে, তাকে ফাঁকি দিতে গেলেই নিজেকে ফাঁকি দেওয়া হয়'। মাটির দীর্ঘ অপব্যবহারের মাধ্যমে কথাটি বর্ণে বর্ণে সত্য প্রমাণিত করে আজ মানুষ নিজেই পড়েছে এক মস্ত ফাঁকিতে, মস্ত বিপদে। একদিকে মানুষের একতরফা মাটির স্বাস্থ্য বিরোধী বিভিন্ন কাজের ফলে অবক্ষয়ের চরম সীমার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে এই গ্রহের মৃত্তিকা সম্পদ, অন্যদিকে এর ফলে আবার ঘোরতর বিপাকে পড়েছে সেই মানুষই। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদ মাটি, যেটি মানুষকে একাধারে দিয়েছে প্রাণ, পোষণ ও পুষ্টি, তার অনাদর, অবহেলা, নিত্য নিগ্রহ ও তার সার্বিক পরিষেবার প্রতি মানুষের বিবেক-বুদ্ধির দীর্ঘদিনের এক অকৃতজ্ঞ উদাসীনতা, প্রকারান্তরে মানুষ তথা গোটা বাস্তুতন্ত্রের অস্তিত্বটাকেই আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।বৈজ্ঞানিক সত্যটি হলো, মাটির ক্রমাগত ক্ষয় ও গুণমান হারানোর ফলে শেষপর্যন্ত মাটি ব্যবহারের একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে পড়লে বা এককথায় মাটির মৃত্যু হলে, বাঁচবেনা মানুষও। এবছর ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের শ্লোগান, 'আমাদের ভূমি...আমাদের ভবিষ্যৎ'-এর মাধ্যমে অনেকাংশে এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটিকেও বোধহয় জাতিসংঘ মানুষের সামনে আনতে চাইছে, সম্পর্কিত আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সঙ্গে।
সত্যি, এক আশ্চর্য বস্তু এই মাটি! বহু বছর ধরে প্রকৃতির বুকে তৈরী হওয়া বিভিন্ন অজৈব উপাদান, জৈব উপাদান, বায়ু ও জলের এক জাদুকরী সমন্বয়। ভাবতে অবাক লাগে, জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক টেবিল চামচ মাটিতে নাকি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের চেয়ে বেশি সংখ্যায় জীবন্ত প্রাণী রয়েছে! যদিও প্রকৃতিতে মাত্র ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার মাটিতৈরী হতে সময় লাগতে পারে ১০০০ বছর পর্যন্ত। এইভাবে সুদীর্ঘ সময় ধরে যে মাটি তৈরী হয়, মানুষ তাকে নষ্ট করে ফেলতে পারে অল্প সময়েই। যদিও মাটি ধ্বংস করতে পারলেও মাটি কিন্তু তৈরী করতে পারেনা মানুষ। যাই হোক, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশই আসে এই মাটি থেকে। শুধু আমাদেরই নয়, উদ্ভিদকূলের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় ১৮ টি প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন রাসায়নিকের মধ্যে ১৫টিই সরবরাহ করে এই মাটি। প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবেও মাটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটিতে অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে জলকে বিশুদ্ধ ও সংরক্ষণ করে মাটি। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ১ ঘনমিটার 'সুস্থ মাটি' বা যথাযথ গুণমানসম্পন্ন মাটি , ২৫০ লিটারের বেশি জল ধরে রাখতে পারে। কাজ করতে পারে 'কার্বন সিঙ্ক' হিসেবে বা ধরে রাখতে পারে বিপুল পরিমান কার্বনও। তবে মাটির ঠিকঠাক ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনা না হলে তা প্রভাবিত করে মাটির উর্বরতা, মাটি ক্ষয়, মাটির জীব বৈচিত্র ইত্যাদিকে। জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত ৭০ বছরে, খাদ্যে ভিটামিন ও পুষ্টির মাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। গোটা পৃথিবীতে ২০০ কোটি মানুষ ভিটামিন ও খনিজের বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস-এর অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছেন কারণ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস থেকে ভিটামিন ও খনিজ শোষণ করে শরীর। ক্রমবর্ধমান এই 'লুকোনো খিদে' মেটানো ছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আগামী ২০৫০ সালের পৃথিবীতে খাদ্যের সার্বিক চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন ৬০ শতাংশ বাড়াতে হবে। সত্যি এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ গ্রহের ৪০ শতাংশ জমি ইতিমধ্যেই অবক্ষয়িত হয়েছে। প্রভাবিত হয়েছেন বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ। হুমকির মুখে গ্লোবাল জিডিপির প্রায় অর্ধাংশ। খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে বাড়ছে জলের অভাব। বাড়ছে দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও স্থানান্তরে যাত্রা বা পরিযান। দ্রুততর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। কমছে বিভিন্ন 'ইকো সার্ভিস' বা বাস্তুতন্ত্রের নানা সুযোগ-সুবিধা। মাটির অবক্ষয় সংক্রান্ত একটি পযবেক্ষণে দেখা গেছে, আমাদের ভারতের মাটিতে গড় জৈব উপাদান রয়েছে মাত্র ০.৬৮ শতাংশ। যা কাম্য পরিমানের তুলনায় অনেকটা কম। দেশের ৭০ শতাংশেরও বেশি মাটি হয় অম্লত্ব অথবা ক্ষারত্বের সমস্যায় ভুগছে। ৫৫ শতাংশ মাটিতে নাইট্রোজেন, ৪২ শতাংশ মাটিতে ফসফরাস এবং ৪৪ শতাংশ মাটিতে জৈব কার্বনের ঘাটতি রয়েছে, জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে যা মাটির স্বাস্থ্যের একটি প্রধান নিয়ামক। এমনটাই জানা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৯-২০ সালের 'সয়েল হেলথ সার্ভে' থেকে। এছাড়া বর্তমানে মাটির ক্ষয়, দেশের স্থলভাগের ৩০ শতাংশ অঞ্চলকে প্রভাবিত করছে। আসাম ও ওড়িশার কিছু অঞ্চলে তো বিপর্যয়করভাবে, বছরে, প্রতি হেক্টরে ১০০ টন মূল্যবান 'টপ সয়েল' বা মাটির উপরের স্তর হারিয়ে যাচ্ছে। এমনটাই জানা যাচ্ছে 'আউটলুক প্ল্যানেট' এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে। আবার, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস সূত্রে জানা যাচ্ছে নানা কারণে দেশে, বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে মাটির ক্ষতির পরিমান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৫.৩৫ টন। অনেক জায়গায় দীর্ঘসময় জল জমে থাকাও মাটির লবণতা সহ নানা আনুষঙ্গিক সমস্যা ডেকে আনছে। অ-কৃষি কাজে ক্রমশ বেশি জমি ব্যবহারের জন্য উর্বর মাটির বিশাল অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর নানা কারণে মাটি ক্ষয়ের জন্য ৭৪ মিলিয়ন টন প্রধান পুষ্টি উপাদান নষ্ট হচ্ছে। তবে সম্প্রতি আরো ভয়াবহ তথ্য উঠে আসছে ইসরো সূত্রে। জানা যাচ্ছে, দেশের সমস্ত রাজ্যেই নাকি গত ১৫ বছরে অবক্ষয়িত জমির পরিমান বেড়েছে! গত বছরে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে ঝাড়খন্ড, রাজস্থান ও দিল্লিতে ৬০ শতাংশের বেশি জমিতে অবক্ষয়ের ছোবল পড়েছে। পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে। দিল্লিস্থিত দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের হুঁশিয়ারি, অবক্ষয়িত জমি পুনরুদ্ধারের কাজ দ্রুত না করলে, ২০৩০ সালে জমির ক্ষয়ক্ষতির খরচ, পুনরুদ্ধারের খরচকে ছাড়িয়ে যাবে! প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশেরও বিস্তৃত ভূমির প্রায় ৭৬ শতাংশ অঞ্চলে বা ১১.০৭ মিলিয়ন হেক্টর জমির মাটিতে পুষ্টির ঘাটতি প্রকট। এর মধ্যে আবার ১.৪৭ মিলিয়ন হেক্টর জমি, মাটির মারাত্মক পুষ্টি-হ্রাসের কবলে পড়েছে যা উৎপাদনশীলতার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ নষ্ট করে, জমিকে চাষের জন্য আরও বেশি অনুপযুক্ত করে তুলছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এখন তাহলে গোটা পৃথিবীরচিত্রটা ঠিক কেমন দাঁড়িয়েছে? ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে পৃথিবীতে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লক্ষ হেক্টর 'এগ্রিকালচারাল সয়েল' বা কৃষি-মাটি, মাটির ক্ষয়ের মাধ্যমে হারিয়ে যায়। পৃথিবীর ৫২ শতাংশ কৃষি-মাটির এলাকা ইতিমধ্যেই অবক্ষয়িত হয়ে গেছে। আগামী ৬০ বছরে পৃথিবী থেকে চাষযোগ্য মাটি শেষ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। ওদিকে পৃথিবীতে ক্ষুধাপীড়িত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি। মাটির বিলুপ্তি আটকানো না গেলে আগামী ২০ বছরে খাদ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে মনে করছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ছে, সয়েল ইরোসন ও ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন বা মাটির ক্ষয় ও ভূমির অবক্ষয়, পৃথিবী জুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জনের পথে ক্রমশ একটা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর জন্য এখনই আপস করতে হচ্ছে বিশ্বের অন্তত ৩২০ কোটি মানুষের ভালো-মন্দের সঙ্গে। সব মিলিয়ে অবস্থা সত্যি অত্যন্ত আশংকাজনক।
এবার একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক, মাটির যে অবক্ষয় নিয়ে এত আশঙ্কা, এত আলোচনা, সেই বিষয়টা আসলে ঠিক কেমন। যখন নাকি মাটি, জীবনকে পরিপোষণ করে এমন ভৌত, রাসায়নিক বা জৈবিক গুণাবলী হারায় তখন হয় মাটির অবক্ষয়। আদতে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যদিও মানুষের নানা অবাঞ্ছিত কাজে, অবক্ষয় আজ দ্রুত হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীতে মাটির এ সংকট ঠিক ঘনালো কিভাবে? ভিলেন হিসেবে উঠে আসছে জনসংখ্যা ও শহরাঞ্চলের পরিসর বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান দূষণ ও বর্জ্যের রমরমা, জলবায়ু পরিবর্তন, অরণ্য বিনাশ, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, অনুপযুক্ত মাটি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মতো বিষয়গুলি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে দূষণ মাটির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জীবাণুকে হত্যা করছে, অরণ্যবিনাশ ও তথাকথিত উন্নয়ন মাটির গঠন কে নষ্ট করে মাটি ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, চাষবাস ও নগরায়ণের সঙ্গে যুক্ত মাটির সংকোচন, মাটিতে বাতাসকে চেপে ধরছে এবং জল শোষণে বাধা দিচ্ছে। মানুষের কার্যকলাপে বেড়ে চলা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও মাটি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য নিবিড় চাষ, বিশেষত লাগাতার একফসলি চাষ, মাটির বড় সর্বনাশের কারণ হচ্ছে। একই জমিতে একটি ফসল বার বার জন্মানোর ফলে তা মাটির নির্দিষ্ট পুষ্টিগুণ টেনে নেয় এবং কীট পতঙ্গ, রোগ-জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত হয়। আবার এই সমস্যাগুলির মোকাবিলায় কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র নষ্ট করছে এবং নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার মাটির জৈব অংশের ভাঙ্গনকে দ্রুত করছে, ক্ষুধাপীড়িত হয়ে পড়ছে মাটির আণুবীক্ষণিক প্রাণীজগত। মাটির আণুবীক্ষণিক জীবাণু-জীবন, উদ্ভিদের আবর্জনা ও প্রাণীর বর্জ্যের জৈব উপাদান থেকে বাঁচার রসদ পায়। তাইমাটি থেকে জৈব উপাদান নিঃশেষ হয়ে গেলে জীবাণু-জীবন বাঁচতে পারে না, যে জীবাণু-জীবন সুস্থ মাটির অন্যতম শর্ত। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চাষের মাটিতে জৈব উপাদান ৩ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে থাকা দরকার হলেও বর্তমানে বিশ্বের বড় অংশে এটি ১ শতাংশেরও কম! এইভাবে মাটির গুনাগুন যেমন ক্রমশ কমে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে কমেযাচ্ছে ফসলের পুষ্টিগুণও। এমনকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, অনেক সময় টিলিং বা চাষ দেওয়া এবং সেচও মাটির গঠন ও গুনাগুনের ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব আনতে পারে। আবার আমাদের মতো জনবহুল দেশে, চাষের এলাকা বাড়ানো কঠিন তাই খাদ্যের বেড়ে চলা চাহিদা সামলাতে, চাপ পড়ছে বর্তমান আবাদি এলাকায় উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর। এর জন্য মাটির বিশেষভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছে মাটি, প্রকারান্তরে যা এখন আমাদের স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করছে। এমনটাই জানা যাচ্ছে 'ডাউন টু আর্থ'-এর একটি প্রতিবেদন থেকে। যাই হোক, সবমিলিয়ে এখনো পর্যন্ত মাটির অবক্ষয়ের যে যে রূপগুলি আমাদের সামনে নখ দাঁত বার করে ধরা দিচ্ছে সেগুলি হল, মাটির দূষণ, মাটির ক্ষয়, অম্লতা, লবনতা, জৈব কার্বন ক্ষয়, জীব বৈচিত্র নষ্ট হওয়া, পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই, এর সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব কিভাবে? যেহেতু মাটিঅবক্ষয়ের কারণ অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা, তাই সমস্যার প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। একদিকে যেমন পর্যাপ্ত বনসৃজন অন্যদিকে মাটির স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ এমন কৃষি পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন, নিয়ন্ত্রিত পশুচারণ, মিশ্র ফসলের চাষ, ফসলের আবর্তন বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকম ফসলের চাষ ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া, যেগুলি মাটির গঠন ও গুণমানের পক্ষে সহায়ক। মাটিবাঁচাতে সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক একটি মাটি ব্যবস্থাপনার আজ কোনো বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে একদিকে নানারকম কর্মসূচি নিয়ে যেমন সক্রিয় জাতি সংঘ, তার সহযোগী সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি, অন্যদিকে দেশে-বিদেশে নানা সংগঠন ক্রমশ সরব হচ্ছে 'মাটি বাঁচাও' আন্দোলন নিয়ে। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস, পরিবেশ দিবস ইত্যাদি জাতিসংঘের মাটি ও পরিবেশকেন্দ্রিক কর্মসূচীগুলি এবং ভারতীয় যোগগুরু সদগুরুর নেতৃত্রে মাটি বাঁচাও আন্দোলন, মাটির কথা, মাটির ব্যাথাকে মানুষের সামনে তুলে ধরছে বেশ কার্যকরভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণে যুক্ত বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার বা আইইউসিএন, সমদর্শী আইকেইএ ফাউন্ডেশন-এর মতো সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পরিবেশবান্ধব টেকসই কৃষির পক্ষে আওয়াজ তুলেছে যা আখেরে মাটি বাঁচানোর পক্ষেই কাজ করবে। আইইউসিএন সমর্থন করছে দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেওয়া, সদগুরুর ঈশা ফাউন্ডেশনের মাটি বাঁচাও আন্দোলনকেও। তৈরী হচ্ছে একটি গ্লোবাল পলিসির পক্ষে বিশ্ব জনমত। ভারত সরকারও মাটিবাঁচানোর লক্ষ্যে আপাতত ৫ টি ক্ষেত্রে প্রয়াসের উপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছে। এগুলি হল, মাটিতে বসবাসকারী প্রাণীদের বা মাটির জৈব পদার্থকে কিভাবে বাঁচানো যায়, কিভাবে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখা যায় এবং জলের প্রাপ্যতা বাড়ানো যায়, কম ভূগর্ভস্থ জলের কারণে মাটির যে ক্ষতি হচ্ছে তা কিভাবে দূর করা সম্ভব এবং বনভূমি হ্রাসের ফলে মাটির ক্রমাগত ক্ষয় কিভাবে রোধ করা যায়। এছাড়া ভারতে, ২০৩০ সালের মধ্যে, ২.৬ কোটি হেক্টর ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণাটিও, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংসের মতো আসন্ন হুমকির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্যমাটির অবক্ষয়কে উল্টোমুখী করা, থামিয়ে দেওয়া বা অবক্ষয়ের গতিকে কমিয়ে দেবার জরুরি প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে।
যদিও মাটি বাঁচাতে যেমন কাল-ই সর্বত্র, অবাঞ্ছিত রাসায়নিক মুক্ত, জৈব চাষ শুরু করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, মাটির স্বাস্থ্য বিরোধী সমস্ত কার্যকলাপে রাতারাতি লাগাম পরানো। অনেকটা পথ যে আমরা ভুলভাবে পেরিয়ে এসেছি। মাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনাকাঙ্খিত কাজকর্ম ও ভাবনাচিন্তা হয়ে গেছে মজ্জাগত, হয়তো কিছুটা অজান্তে, হয়তো বা কিছুটা বাধ্যবাধকতায়। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, আজ আত্মসমীক্ষার সময় এসে গেছে। এই গ্রহে মাটি আর জীবন যেখানে সমার্থক, সেখানে জীবনের জন্য মাটিকে রক্ষা করতেই হবে, যে কোনো মূল্যে। কোনো দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও শুভবুদ্ধির সমন্বয়ে সময়োপযোগী, উপযুক্ত প্রয়াস, আমাদের একটা বড় ভরসার জায়গা হতে পারে।
* অনলাইন পত্রিকা থেকে সংগৃহীত