মমতা কি দুই বাংলার সম্পর্কে ফাটল ধরাবে!

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  ২৭ জুন ২০২৪, ১১:৪৭

ফারাক্কা এবং তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনি চিঠিতে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং ফরাক্কার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোরকম চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনো আপস করবো না।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে, মমতার আপত্তিতে কি এই চুক্তি থেমে যেতে পারে? এ প্রসঙ্গে ফেডারেল সরকারের বিধান এবং ভারত সংবিধানে এ বিষয়ে কী বলা আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখা।
প্রসঙ্গত, গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। এই আবহে সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে এক বৈঠক হয়। সেখানে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবায়নের জন্য ‘যৌথ কারিগরি কমিটি’ তৈরি করা হয়েছে। কার্যত এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, রাজ্যকে ‘পাশ কাটিয়ে’ ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন বা তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ‘অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত’। মূলত তিনি ‘ফারাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবায়ন এবং তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পূর্ণভাবে ফেডারেল সরকারের আওতাভুক্ত।
এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির বিষয়টি খুব বেশি আমলে নেওয়ার আইনগত ভিত্তি রয়েছে কি না সেটি ভেবে দেখা দরকার। হয়তো ফেডারেল সরকারের আন্তঃসম্পর্কের কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এমনকি ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় যাতে কোনো ভাঙন তৈরি না হয় সেজন্য মমতার এই চিঠিকে বিশেষ একটি ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তি থাকলে ভারত সরকার চুক্তি করতে পারবে না- এমনটি নয়। সংবিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তির সম্পূর্ণ এখতিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের। অথচ মমতা বলেন, যেভাবে তিস্তা অ্যাকশন প্ল্যানের চুক্তি করা হয়েছে, তা-ও ঠিক নয়। রাজ্য এড়িয়ে এই ধরনের চুক্তি করা যায় না। তার এমন বক্তব্য পরিপক্বতার প্রমাণ দেয় না।
মমতার এই চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক থেকে এই দুই অঞ্চলের বিশেষ একটি মিল রয়েছে। তাছাড়া মমতাকে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ বন্ধু বলে বিবেচনা করে। এ কারণে মমতার এমন আপত্তির বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
তিস্তা এবং ফারাক্কার জলবণ্টন নিয়ে মমতার আপত্তি প্রসঙ্গে ২৪ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন যে, এই বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। কারণ এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তিনি আরও বলেন, ভারতে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক রয়েছে। যে তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
বাংলাদেশের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করে মোদীকে লেখা চিঠিতে মমতা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণকে ভালোবাসি ও সম্মান করি এবং সব সময় তাদের মঙ্গল চাই।’ অতীতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য সরকার ‘সহযোগিতা করেছে’ দাবি করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন এবং এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য রেললাইন ও বাস সেবা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে করা কয়েকটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ যৌথ কাজ রয়েছে। তবে পানি খুবই মূল্যবান ও জনগণের জন্য লাইফলাইন। জনগণের ওপর বহুমাত্রিক ও মারাত্মক প্রভাব ফেলা এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে আমরা কোনো ছাড় দিতে পারব না। এ ধরনের কোনো চুক্তি হলে তার ভয়ঙ্কর প্রভাবের শিকার হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।’
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে অভিন্ন নদী তিস্তা ও গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। এ ঘটনায় মমতাকে দায়ী করছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র ‘পানি বিক্রি’ করতে চাইছে বলে মমতা যে অভিযোগ করেছেন, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে কেন্দ্র বলছে, তিস্তা ও গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে আগেই জানানো হয়েছিল। গত বছরের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখেছিল কেন্দ্র। তাতে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন বিষয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটিতে রাজ্যের পক্ষ থেকে মনোনীত প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল।
ওই বছরের ২৫ আগস্ট রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কমিটির জন্য রাজ্যের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে মনোনীত করা হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিথ্যা বলছে যে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনায় তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। মমতার সাম্প্রতিক চিঠিতে কেন্দ্রের আগের চিঠির বিষয়ে উল্লেখ নেই বলে কেন্দ্র অভিযোগ তুলে ধরে।
মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা কিংবা তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন মমতা ব্যানার্জী। অথচ অভিন্ন নদী তিস্তা ও গঙ্গার সুষ্ঠু পানি বণ্টন বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি জোরদার করতে এ বিষয়ে পুনরায় ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি কোনোভাবেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইঙ্গিত বহণ করে না। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জীর অবস্থান আন্তর্জাতিক নদী আইন এবং ভারতের ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার জন্য এক ধরনের অসঙ্গতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
মমতার এই চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক থেকে এই দুই অঞ্চলের বিশেষ একটি মিল রয়েছে। তাছাড়া মমতাকে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ বন্ধু বলে বিবেচনা করে। এ কারণে মমতার এমন আপত্তির বিষয়টি বাাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]