প্রতিটি সন্তানই বাবা-মায়ের কাছে রবের দেওয়া এক নেয়ামত। প্রত্যেক বাবা- মাই চায় সন্তান যেন জ্ঞানে-গুণে-বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানে-সম্মানে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। সে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে আমরা জীবন মাঠে নামিয়ে দিই শিশুর শৈশবকাল থেকে, নিজেদের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে। ব্যাগভরতি বই কোচিং টিউটরের পড়া তৈরি করতে করতে মধুর শৈশব তাকে হাতছানি দিয়ে আর ডাকে না। যান্ত্রিক জীবনের জাঁতাকলে সন্তানকে আমরা পিষ্ট করে দিই। আনন্দ উচ্ছ্বাস, বন্ধুদের সঙ্গে মিশে নিজেকে মেলে ধরার সময়টা দিই না। কেড়ে নিই সন্তানের আনন্দময় শৈশব। নিরানন্দ এক শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে সন্তানদের বন্দি করে রাখার প্রয়াস করি।
শৈশবকাল থেকে লেখাপড়ার চাপের মধ্যে রেখে সন্তানদের বড় করে তুলছি। অথচ বাঁধা-বন্ধনমুক্ত আনন্দময় একটা শৈশব প্রত্যেক শিশুর অধিকার। কিন্তু আমরা অভিভাবকরা সেটা থেকে সন্তানদের বঞ্চিত করছি। শৈশব থেকে সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে তোলার চেষ্টা করি। প্রত্যেক পরীক্ষায় সন্তান এ প্লাস পাবে সে আশা নিয়ে নামকরা কোচিং এবং টিউটর রেখে লেখাপড়া করার চেষ্টায় থাকি। কিন্তু কারো লক্ষ্য থাকে না সন্তান যেন নৈতিকতা সম্পন্ন সৎ চরিত্রবান একজন মানুষ হোক। মানবতাবাদী একজন মানুষ হোক। দেশপ্রেমিক একজন মানুষ হোক। পরীক্ষার সাফল্যে জীবনের সাফল্য হিসেবে ভাবার রীতি হয়ে গেছে। পাশের বাসার ছেলে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার আমার ছেলেকেও তা হতে হবে। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা আজ আমাদের মধ্যে শুরু হয়েছে।
এ অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানকে আমরা রোবট বানিয়ে ফেলছি। তার ফলও পরবর্তী জীবনে আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। মা-বাবার শেষ আশ্রয় হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। কিংবা সন্তান বিদেশে গিয়ে আর ফিরছে না মা-বাবার কাছে। কারণ সে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেশেনি। আত্মকেন্দ্রিক করে শৈশব থেকে আমরা বড় করে তুলেছি সন্তানকে। তাকে শেখায়নি প্রতিবেশী অনাহারে থাকলে নিজের খাবারের কিছু অংশ তাকে দেওয়ার মধ্যে বেঁচে থাকার সার্থকতা। সবার সুখে হাসা এবং সবার দুঃখে কাঁদার মধ্যে মনুষ্যত্ব। সে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিতে পারিনি অভিভাবক হিসেবে। তাই বড় হয়ে সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভাবছে না। নৈতিকতা শেখানোর তোয়াক্কা না করায় বড় হয়ে সন্তান হচ্ছে খুনি, সন্ত্রাসী, মাস্তান, অমানবিক মানুষ।
সেজন্য শৈশবকাল থেকে সন্তানকে সবার সঙ্গে মিশতে দিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, মানবতা, আদর্শ, সৎ, চরিত্রবান, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য সহযোগিতা করতে হবে অভিভাবক হিসেবে। পাড়া-প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আনন্দ-বেদনা উপলব্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তবেই সুন্দর ভবিষ্যৎ সন্তানের রচিত হবে। এ দায়িত্ব শৈশব থেকে অভিভাবককে নিতে হবে। অভিভাবকদের হতে হবে সচেতন যেন সুপরিকল্পিতভাবে তার সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়