আক্রান্ত বাংলাদেশ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে

হীরেন পণ্ডিত
  ২৭ জুলাই ২০২৪, ১৪:১৮

কোটার যৌক্তিক সংস্কার সবাই চেয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভিন্ন কৌশলের অবলম্বন হিসেবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঞ্চনার ক্ষোভ সঞ্চারিত করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চাকরি সব নিয়ে নিচ্ছে, এই সরল হিসাবে তাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭৫-এর পর ২১ বছর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত ছিল। কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রচলন করে। তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে কোটার বিরুদ্ধে মাঠে নামায় স্বাধীনতার অপশক্তি।
মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে দেশের জন্য লড়েছেন, শহীদ হয়েছেন। যখন যুদ্ধ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই তারা ভাবেননি, তাদের সন্তানরা কোটায় চাকরি পাবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের রক্তে আজকে স্বাধীন দেশে বসে কোটা নিয়ে আন্দোলন করছেন। দেশ স্বাধীন না হলে এই শিক্ষার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানের কোটার জন্য আন্দোলন করতে হতো। তাই এ দেশটার ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি একটু বেশিই থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের অনেকেই ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না।
সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর ১০ জুলাই এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছিল আপিল বিভাগ। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। আন্দোলনকারীরা বলেছে, এ দাবি নির্বাহী বিভাগ থেকে যতক্ষণ না পূরণ করা হবে ততক্ষণ তারা রাজপথে থাকবে। ১৪ ও ১৫ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। তবে ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করে ১৭ জুলাই। পুলিশ, আনসার, ছাত্র, পথচারীসহ বিভিন্ন পেশার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। যে কোনো মৃত্যুই কষ্টের, এমনও দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম।
দুর্বৃত্তদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সেসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা যেগুলো বিশে^র কাছে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে এবং দেশের মানুষ এগুলো নিয়ে গর্ব করছে। ধ্বংস করা হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, মহাখালী এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা যেগুলো পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সময় লাগবে। মেট্রোরেল-এর কাজীপাড়া, মিরপুর ১০ স্টেশন ও দিয়াবাড়ি স্টেশন যেগুলো সচল করতে কমপক্ষে এক বছর লাগবে, এ সমস্ত এলাকার জনগণ যে যানজটের কবল থেকে মুক্ত পেয়েছিলেন তাদের আবারও অনিশ্চয়তা দেখা দিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিটিভির সমস্ত আর্কাইভ, ১৭টি গাড়ি, ৩০টি মোটরসাইকেলসহ পুরো ভবন জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কমিটি গঠন করা হয়েছে, এখনো তা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। মহাখালী ডাটা সেন্টার, চট্টগ্রাম থেকে আসা অপটিক্যাল ফাইবার, ইন্টারনেটের অন্যতম প্রধান উৎস, সেতু ভবন পুরো ধ্বংস করা হয়েছে, ৫৭টি গাড়ি ও ২০টি মোটর সাইকেল জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ৫৩টি গাড়ি, ৩২টি মোটরসাইকেল, সার্ভারসহ পুরো ভবন জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অধিদপ্তরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর অফিসের ময়লার গাড়িসহ ২৩টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০৫ কোটি টাকার বেশি। বিজিএমইএ ভবনও রেহাই পায়নি। ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো কার্যালয়ে। সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা এক হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকার আরও বিভিন্ন এলাকায় ও সারাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তার পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা না গেলেও এর পরিমাণ আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি হবে।
পরিকল্পিতভাবে ঢাকার ২০টি পয়েন্ট যেমন যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে, পল্টন, বিজয়নগর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ডেমরা-ঢাকা হাইওয়ে, সিলেট যাবার পথ, যমুনা সেতু পার হয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপদে যাবার রাস্তা, ধানমন্ডি ১৯, ধানমন্ডি ২৭, জিগাতলা, ধানমন্ডি ১৫, শংকর, রায়েরবাজারের রাস্তা, ফার্মগেট, রায়েরবাগ, কাজীপাড়া, মিরপুর ১০, মোহাম্মদপুর, বসিলা, গুলিস্তান, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, উত্তরা, আজমপুরসহ আরও বেশকিছু জায়গায় সরকারি অফিস অবকাঠামোসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
ঢাকার বাইরেও সরকারি স্থাপনাগুলোই ছিল মূল লক্ষ্য। ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলাকেও টার্গেট হিসেবে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে রয়েছেÑ গাজীপুর, ঢাকা জেলার সাভার, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, বগুড়া, রংপুর ও কিশোরগঞ্জ। নরসিংদী জেলা কারাগার ভেঙে ৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন কয়েদিকে অস্ত্র, গুলি, টাকা-পয়সা লুট করে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে। দুর্বৃত্তরা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন অবকাঠামোতে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে এগুলো ঠিক করে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা কঠিন হবে এবং অনেক সময় লাগতে পারে। পুরো বাংলাদেশে আক্রমণ চালানো হয়, এমন কোনো জেলা নেই যেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই।
চলমান সহিংসতা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৯ জুলাই কারফিউ ঘোষণা করে সেনাবাহিনী নামাতে বাধ্য হয় সরকার। সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করছে। মনে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত, স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত। হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে পুনর্গঠন কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, নৌপরিবহন এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের ওপর গুরুত্ব দেন। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করা হয়।
সেই দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দিয়েছে এই নারকীয় হামলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে রোধ করার জন্যই এই হামলা। তবে হামলাকারীরা জানে না বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তার নির্বাসিত কন্যা শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে হাল ধরেছিলেন। গণতন্ত্রের সংগ্রামে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় দল হিসেবে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এনেছেন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য নিরলস কাজ করছেন। তিনি এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির পাশাপাশি সব রকম শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধে সব সময় রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার, প্রতিবাদী ভূমিকা রেখে এসেছেন এবং এখনো রাখছেন।
এই নারকীয় হামলার ক্ষতি কাটিয়ে তিনিই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি নিশ্চয়ই এই দেশকে দুঃসময়ে দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা প্রধানমন্ত্রী কঠোর পরিশ্রম ও মেধা-মনন দিয়ে বাস্তবায়িত করে যাচ্ছেন, এক নাগাড়ে তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পারবেন এই দুর্যোগ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।
হীরেন পণ্ডিত : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো