এত গুলি, এত রক্ত, এত প্রাণহানি কি বৃথা যাবে? নিজ দেশের জনগণের বুকে গুলি চালিয়ে কি কোনো সরকার টিকে থাকতে পেরেছে? গত এক দেড় সপ্তাহ ধরে মানুষের মুখে মুখে মানুষের মনে মনে এ ছিল উদ্বেগময় প্রশ্ন। একের পর এক দিন যায়। বাড়ে প্রাণহানি। বাড়ে গণগ্রেপ্তারের মাত্রা। বাড়ে রাস্তায় ছাত্র-জনতার জোয়ার।
এরপরও সরকার তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে না। আমরা প্রশ্ন করে গিয়েছি, সরকার কেন দেশের লাখো তরুণের ভাষা পড়তে পারছে না। কেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারছে না? সরকার কেন বুঝতে পারছে না, দিন শেষে তার কী পরিণতি হবে? এই দাম্ভিকতা, ঔদ্ধ্যতা ও স্বৈরাচারিতার কী ফল হবে কেন তারা বুঝতে পারছে না? হায়, ইতিহাস বলে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
গত রাতে যেন নেমে এসেছিল হাজার বছরের পুরোনো রাত। রোববার নতুন করে শতাধিক মৃত্যুর পর আজকে কী হবে—সেই চিন্তায় ঘরে ঘরে মানুষের ঘুম আসে না। এত দিন পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেও পারেনি সরকার। গতকাল দেশজুড়ে অস্ত্রধারী নিজের দলীয় বাহিনী নামিয়ে যা করা হলো, তা ছিল খুবই ভয়াবহ।
সাধারণ ছাত্র-জনতার রক্ত তো ঝরলই, উন্মত্ত জনতার হাতে শুধু এক থানাতে অনেকজন পুলিশ সদস্যও নিহত হলেন। এটি ছিল খুবই অসহনীয়। এরপরও ঘোষণা দেওয়া হলো ঢাকায় ছাত্র-জনতার লংমার্চ ঠেকাতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হবে।
ফলে আজ সকালে কী হবে, এটিই ছিল মানুষের মুখে মুখে। সারা রাত অনেকটা নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল এল। ফোন হাতে নিয়েই ফেসবুকে ঢুকে দেখতে থাকলাম, আজকে ঘোষিত লংমার্চের কী অবস্থা? খুব একটা আভাস পাওয়া গেল না। কেউ বলছে মানুষ ঢুকছে, কেউ বলছে ঢাকার সকাল শান্ত। অনেকে ফোন দিচ্ছিলেন। রাত থেকে অনেকে পরিস্থিতি জানতে চাইছিলেন, অনেকে আবার বিদায় নিচ্ছিলেন এই বলে—আর হয়তো দেখা না-ও হতে পারে!
কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী হতে যাচ্ছে আসলে। এর মধ্যে সকালটা শুরু হলো থমথমে মেঘ দিয়ে। শুরু হলো বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আসলে কিসের? এই মেঘ আসলে কিসের? সরকারের মন বিগলিত হওয়ার নাকি মানুষের বিজয়ের, নাকি আরও অন্ধকার দিকে যাত্রার। রিকশা নিয়ে বের হলাম অফিসের দিকে। মগবাজারের মোড়ে পুলিশের তৎপরতা দেখলাম। মানুষ ও গাড়িকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল। অফিসে আসতে না আসতেই টোটাল ইন্টারনেট শাটডাউন। মনটা আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠল।
প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়েছেন সংবাদ শোনার পর ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষের বিজয় উল্লাস। কারওয়ানবাজার।ছবি: রাফসান গালিব
সংবাদমাধ্যমের মানুষ হওয়ায় জানতে পারছিলাম, ঢাকায় মানুষ ঢুকছে। কোথাও কোথাও গণজমায়েতও হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ভোরে শহীদ মিনারের জমায়েতে গুলিও চালানো হয়েছে। তাহলে কি আরও রক্তপাত দেখতে হবে আমাদের?
সময় বাড়তে থাকে। একেকটি সেকেন্ড যেন একেকটি বছর। একটু দুপুর হতে না হতেই গুঞ্জন শোনা গেল, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কোনো একটা বন্দোবস্ত হচ্ছে। কিন্তু সেসবে আস্থা রাখতে পারি না। কারণ, এ রকম বন্দোবস্তের কথা কয়েক দিন ধরে শুনে আসছিলাম।
এর মধ্যে টিভিতে স্ক্রল আসতে লাগল—বেলা দুইটায় সেনাপ্রধান জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন তিনি। আসলেই কি তিনি কিছু করতে পারবেন, এ নিয়েও তৈরি হচ্ছিল নানা দোলাচল। সরকারপ্রধান কি আসলে জনমানুষের ভাষা বুঝতে পারবেন, নাকি ক্ষমতা ধরে রাখতে ভিন্ন কোনো প্রচেষ্টা চালাবেন?
বেলা দুইটায় টেলিভিশনের সামনে দাঁড়ালাম। কিন্তু সেনাপ্রধানের ভাষণ পিছিয়ে দেওয়া হলো এক ঘণ্টা। এভাবে দুইবার পেছাল তাঁর ভাষণ। এর মধ্যে ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হলো। দু-একটা সংবাদমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছিল, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে।
এরপর তো মানুষের যে ঢল দেখলাম, এটিকেই বুঝি বলে গণ-অভ্যুত্থান! যে গণ-অভ্যুত্থানের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি, অগ্রজদের মুখে শুনেছি। এরপর তো ছড়িয়ে পড়ল, সংবাদমাধ্যমে খবরও চলে এল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। তখন মানুষের উল্লাস, স্লোগান আর মিছিল দেখে কে! ঢাকার রাস্তা এ কোন মহাপ্লাবন!
অফিসের পেছনে কারওয়ান বাজারের মূল রাস্তা থেকেও মানুষের মিছিলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এরপর রাস্তায় নেমে আসতেই সামনে দিয়ে একজন রিকশাচালক দৌড়ে চলে গেলেন এই বলতে বলতে—স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্ত বাংলাদেশ। এই স্লোগান শোনার পর কী অদ্ভুত অনুভূতি হলো!
এরপর তো মানুষের যে ঢল দেখলাম, এটিকেই বুঝি বলে গণ-অভ্যুত্থান! যে গণ-অভ্যুত্থানের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি, অগ্রজদের মুখে শুনেছি। এরপর তো ছড়িয়ে পড়ল, সংবাদমাধ্যমে খবরও চলে এল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন। তখন মানুষের উল্লাস, স্লোগান আর মিছিল দেখে কে! ঢাকার রাস্তা এ কোন মহাপ্লাবন!
রাস্তায় কোনো পুলিশ নেই, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরাও নেই। ১৫ বছর ধরে অগণতান্ত্রিক আচরণ, সুশাসনের চরম অবনতি, মাত্রাছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও অর্থপাচার, ভয়াবহ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার হরণ—দেখতে দেখতে অনেকের হয়তো এটিই ধারণা হয়ে গিয়েছিল, এসব থেকে হয়তো আমাদের মুক্তি নেই।
ক্ষমতাসীন দলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও যখন বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন আরও বেশি বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ভুলে যেতে বসেছিল। শত শত মেধাবী তরুণ দেশত্যাগ করছিলেন। জীবিকার আশায় অনেক তরুণ ভূমধ্যসাগরে ডুবেও মরছিলেন।
এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আমরা কি কখনো স্বপ্নেও ভেবেছিলাম—ঢাকায় আজকে মানুষের বিজয় উল্লাসের কথা। হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়া সেই তরুণেরাই ন্যায্য দাবি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। মার খেলেন। আবার উঠে দাঁড়ালেন। দিন শেষে তাঁদেরই জয় হলো।
জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁদের আনন্দ দেখলাম, হাসি দেখলাম, উল্লাস দেখলাম। আর দেখলাম উড়ন্ত জাতীয় পতাকা। অচেনা কতজন এসে জড়িয়ে ধরলেন। কেউ কেউ পানির বোতল ফ্রিতে বিলি করছিলেন, কেউ রুটি, কেউ কলা, কেউ বিস্কুট। মানুষের সব স্রোত যাচ্ছে শাহবাগের দিকে। ঘণ্টাখানেক মানুষের উদ্যাপন দেখতে দেখতে একপর্যায়ে খেয়াল হলো রাস্তার অন্য পাশে মিছিল ঘুরে গেছে। বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না, গণভবনের দিকেই হয়তো যাচ্ছে মানুষ।
এরপর অফিসে ফিরেই বুঝতে পারলাম, মানুষ গণভবনে ঢুকে গেছে। খবরও হয়ে গিয়েছে। জানা গেল, সেনাপ্রধান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। কোনো একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্তও হচ্ছে।
অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গণভবনের ভেতরের মানুষের নানা কাণ্ডকীর্তির খবর চলে আসছে। পাশাপাশি এ-ও খবর আসতে লাগল, সরকারদলীয় অনেক মন্ত্রী–এমপি ও নেতার ঘরবাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর হচ্ছে। অনেক জায়গায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এ সব কিছুই নিন্দনীয় ও গর্হিত কর্মকাণ্ড।
সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয় রক্ষার বিষয়টি নিয়ে দুই দিন ধরে আন্দোলনকারীরা সতর্ক করে আসছিলেন। আজকেও সেই সতর্কতা দেওয়া হলো। এর মধ্যে কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুর স্থাপনার ওপর হামলা হয়েছে শুনতে পারলাম। মনটা আবারও বিষণ্ন হয়ে গেল। যদিও সন্ধ্যার মধ্যে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় পাড়ায় পাড়ায় ছাত্রজনতার প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠতে দেখে কিছুটা স্বস্তিবোধও হলো।
কোথাও পুলিশ নেই, কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই। ফলে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কিত হতেই হয়। একটি দেশের এমন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নৈরাজ্য তৈরি হওয়ার ঘটনা নতুনও না, অস্বাভাবিকও না। সেটিই যেন দেখলাম আবার অফিস থেকে বের হয়ে কাছেই একটি টিভি চ্যানেলের ভবন ভাঙচুরের ঘটনায়। টিভি চ্যানেলের গাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে উত্তেজিত মানুষ। কেউ কারও কথা শুনছে না। এগিয়ে গিয়ে কয়েক জনকে বোঝালাম। কেউ শুনল না।
সবকিছু যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমের ওপরে মানুষের ক্ষোভ আছে জানি, সে জন্য এভাবে কোনো সংবাদমাধ্যমে হামলা হবে, তা কোনোভাবে কাঙ্ক্ষিত নয়। মানুষের ক্ষোভের কারণে অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, তা কোনোভাবে মানা যায় না।
আবার, এত সব হামলা, নৈরাজ্যের দায় বিগত সরকারেরও, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশকে গণতন্ত্রহীন করে তোলে অনেক মানুষের মনঃজগৎকেও অগণতান্ত্রিক করে তুলেছে তারা। জুলুম–নির্যাতন চালিয়ে ও দমিয়ে রাখতে রাখতে মানুষকে এতটাই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল তারা, তার প্রতিফলনই কি নয় এই নৈরাজ্য?
অবশ্যই এটিও বলতে হবে, সবাই না; কিছু সুযোগসন্ধানী, অপরাধপ্রবণ বা বেপরোয়া মানুষই এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাঁদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।
ছাত্র-জনতার যে বিজয় হয়েছে, সেটিকে সামনের বাংলাদেশ আরও এগিয়ে নিতে হলে কোনোভাবে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। আন্দোলনকারীদের সমন্বয়কও এই বার্তা দিয়েছেন ইতিমধ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও দ্রুত মানুষের সুরক্ষা ও জানমাল রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
আজকেও দেশের অনেক জায়গায় ছাত্রজনতার বুকে গুলি চালানো হয়েছে। গুলি কখনো সমাধান নয়, সেটি প্রমাণ হয়ে গেছে। অতএব কোনো গুলি না চালিয়ে মানুষকে ঘরে ফেরানোর সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে তাদের এখন।
আন্দোলনকারী ও বিক্ষুব্ধ জনতাও যত দ্রুত বিষয়টি বুঝতে পারবে, যত বেশি শান্ত থাকতে পারবে, যত বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে, তত বেশিই মঙ্গল। আমরা পেছনের বাংলাদেশে আর ফেরত যেতে চাই না। আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় একটি অনিশ্চয়তা দূর হলো, বাকিগুলোও দূর করতে হবে। সাধারণ মানুষের স্বস্তির নিঃশ্বাস যেন তাড়াতাড়ি মিলিয়ে না যায়। এবার আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের পালা। সুন্দর এক বাংলাদেশের দেখা হোক।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই-মেইল: [email protected]