এ বছর জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তখন কি ঠিকমতো চিন্তাভাবনা করে এটাকে ভারতের নতুন সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা হিসেবে নির্ধারণ করেছিল?
এ বছর জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তখন কি ঠিকমতো চিন্তাভাবনা করে এটাকে ভারতের নতুন সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা হিসেবে নির্ধারণ করেছিল?
এটা একটা মধুর উপহাসই বটে যে নাগরিক সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বকে আহ্বান করা হয়েছে একটি সংকটাপন্ন রাষ্ট্রের আপাতবহিরাবরণ হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, এর সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাবান অভিজাতদের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ও নাগরিক সমাজের শ্রদ্ধাভাজন নেতা মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুরোধ করা ছাড়া; যেন তিনি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
এর মধ্যে একটি বার্তা আছে। আর তা হলো যখন সরকার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, তখন রাষ্ট্রকে সবার আগে নাগরিক সমাজের দিকে ফিরতে হয় তার বৈধতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসায় নয়াদিল্লি থেকে তড়িঘড়ি করে ক্রমাগত যেসব মন্তব্য করা হচ্ছে, তাতে অনেকেই জানতে চাইছেন যে এতে ভারতের দিক থেকে ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ ছিল কি না।
যখন এ বছর জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তখন কি ঠিকমতো চিন্তাভাবনা করে এটাকে ভারতের নতুন সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা হিসেবে নির্ধারণ করেছিল? নরেন্দ্র মোদি সরকারের কি এমন বাধ্যবাধকতা ছিল তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদানের পর শিগগিরই হাসিনাকে আবার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য? এসব প্রশ্নের তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর জনপরিসরে নেই।
হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফর কি ভারতের সুবিবেচনার ভিত্তিতে হয়েছিল? নাকি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সঠিকভাবে বিবেচনা করতে না পারায়? এটা কি ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’, না রাজনৈতিক অবিবেচনা?
যদিও আইএনডিএ জোটের দলগুলো বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপের সঙ্গে সহাবস্থান নিয়েছে, তবু তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর দাবি করা উচিত। কেন ও কীভাবে আমরা নিজেরা নিজেদের এ রকম একটা অবস্থায় পতিত করলাম?
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রতিবেশী সবার আগে নীতি’ ঘোষণা করেছে। অথচ প্রতিবেশীদের সম্পর্কে আমাদের জানা-বোঝার অবস্থা এটাই দেখায় যে আমাদের গণমাধ্যম ও গবেষকদের নীতি হলো ‘প্রতিবেশী সবার শেষে’। শুধু ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে’ দায়ী করা হয় কেন? এখানে তো ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতাও’ আছে।
এ প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দিতে হবে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমকেও আরেকটি সমান গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দিতে হবে। শুধু রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’-র অভিযোগ তুললে হবে না, বরং গণমাধ্যমকে নিজেদের ভেতরে তাকাতে ও জিজ্ঞাসা করতে হবে যে ‘কেন গণমাধ্যমের সংবাদ প্রতিবেদনের ব্যর্থতা’ দেখা দিল।
বস্তুত একটি বৃহত্তর ‘বুদ্ধিগত ব্যর্থতা’ দেখা দিয়েছে। কেননা নয়াদিল্লির যাবতীয় গবেষণা সংস্থা ও গণমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক পাণ্ডিত্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল।
ভারতের প্রধান প্রধান প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর কারোরই প্রতিবেশী দেশে নিজস্ব প্রতিনিধি নেই। প্রতিবেশীদের সম্পর্কে ভারতে যে জনমত গড়ে ওঠে, তা প্রধানত ভারত সরকার অথবা বিদেশি তথা পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভাষ্য দিয়ে। গণমাধ্যমগুলোর পেশাগত প্রতিবেদনের শূন্যতা পূরণ হয় অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।
যখন পাকিস্তানে কিছু ঘটে, টিভি চ্যানেলগুলো অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকদের ডেকে আনে, যাঁরা সেখানে অতীতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অথবা ডাকা হয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তাদের, যাঁরা এখনো খোঁজখবর রাখেন। গণমাধ্যমের নিজস্ব দক্ষতা-যোগ্যতা খুব কমই আছে।
চীনে যেখানে নিয়মিতই ভারতীয় সাংবাদিকেরা অবস্থান করেন এবং তাঁদের মধ্যে কয়েকজন খুবই ভালো, সেখানেও গণমাধ্যমে চীনবিষয়ক বেশির ভাগ বিশ্লেষণ আসে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
একসময় নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সাংবাদিকেরা থাকতেন। এখন আর নেই বললেই চলে। এমনকি যখন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, দিল্লিতে বসে থাকা সম্পাদকেরা সেদিকেও তেমন মনোযোগ দেন না।
২০২১ সালে আমেরিকা যখন নাটকীয়ভাবে কাবুল থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তখন সেখানে কোনো ভারতীয় সাংবাদিক ছিলেন না। তবে দ্রুতই সাহসী সাংবাদিক নয়নিমা বসুসহ কয়েকজন সেখানে ছুটে যান।
২০২২ সালে যখন হাজার হাজার তরুণ কলম্বোয় রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে ঢুকে তা তছনছ করে দেন, ভারতের মানুষ তা প্রথমে পশ্চিমা সাংবাদিকদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানতে ও দেখতে পারে। যখন মালদ্বীপের নতুন রাজনৈতিক নেতা দ্বীপটি থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানান, ভারতীয় গণমাধ্যম তখনো জানত না যে সেখানে ঠিক কী হচ্ছে।
ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় তো ভারতের বিশেষ স্বার্থ জড়িতে আর তাই এখানে ও উপকূলীয় অঞ্চলে তার মনোযোগও আছে। অথচ এসব জায়গায় কোনো ভারতীয় সাংবাদিক নেই। সে কারণে এটা মোটেও বিস্ময়কর নয় যে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে যা ঘটে গেল, তার খবর জানতেও ভারতীয়দের আবার সেই পশ্চিমা গণমাধ্যমের দিকে তাকাতে হলো।
সংকটকালীন পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহের নাটকীয় মোড় নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করা ভারতীয় গণমাধ্যমের জন্য মূল বিষয় ও চ্যালেঞ্জ নয়। বরং আসল কাজটা হলো পাশের বাড়ির মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও প্রত্যাশার সংবাদ তুলে ধরা।
যদি রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো, তাহলে প্রতিবেশীদের বিষয়ে ভারতীয় সমাজ ও সরকারকে সম্যক অবহিত রাখা যেত। সে ক্ষেত্রে কূটনীতিক ও গুপ্তচরেরা ঘটনাপ্রবাহ ঠিকমতো অনুসরণে ব্যর্থ হলেও গণমাধ্যম ঠিকই তা পারত।
গণমাধ্যমের প্রবাসী প্রতিনিধিরা একটি দেশের চোখ ও কানের সমতুল্য, যাঁরা প্রায়ই ইতিহাসের প্রথম খসড়া লিখে থাকেন। ১৯১৭ সালে লেনিন ও তাঁর কমরেডরা রাশিয়ায় কী করছিলেন, দুনিয়া তা জানতে পেরেছিল সাংবাদিক জন রিডের পাঠানো বার্তাগুলো থেকে।
একইভাবে মাও সে-তুং চীনে কী করছিলেন, সেগুলো লিখে পাঠিয়েছিলেন এডগার স্নো। দুজনই ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক।
১৯৭১ সালে ঢাকার ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আজকে যেসব বিশ্লেষণ আমরা পাই, তার বেশির ভাগই এসেছে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অবমুক্ত করা নথিপত্র থেকে। গত সপ্তাহে ভারতীয় গণমাধ্যমে যেসব কলাম ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশির ভাগই সেই অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে আসা।
নয়াদিল্লিভিত্তিক গণমাধ্যম ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক বিশ্লেষক বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শত শত শব্দ লিখে চলেছেন এখন। তবে আমার জানামতে, তাঁদের খুব কমই আসলে এর আগে শেখ হাসিনার ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী আচরণ এবং তাঁর নয়াদিল্লি সফরকালে বাংলাদেশে ঘনীভূত সংকট সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেননি বা লেখেননি।
দিল্লি বা কলকাতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের চেয়ে গোয়া ও বেঙ্গালুরুর দুজন বিশ্লেষক বরং বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে, সেটা অনেক ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষণমূলক পুনর্বিবরণ প্রয়োজনীয় বটে।
কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে আমাদের জানা-বোঝা যদি ঘটনা-পরবর্তী বিশ্লেষণ ও মাথা চুলকানোর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে, তাহলে একটি দেশকে, এর বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে ও সরকারকে এ রকম ঘটনা মোকাবিলায় প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে এসব লেখার কী উপযোগিতা আছে।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং মৃতপ্রায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা পরিষদকে (সার্ক) উজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর মুহাম্মদ ইউনূস যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে ভারতীয় অভিজাত আমাদের প্রতিবেশীদের বিষয়ে কতটা ব্যর্থ।
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রতিবেশী সবার আগে নীতি’ ঘোষণা করেছে। অথচ প্রতিবেশীদের সম্পর্কে আমাদের জানা-বোঝার অবস্থা এটাই দেখায় যে আমাদের গণমাধ্যম ও গবেষকদের নীতি হলো ‘প্রতিবেশী সবার শেষে’। শুধু ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে’ দায়ী করা হয় কেন? এখানে তো ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতাও’ আছে।
দ্য ওয়ার ডট ইন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ আসজাদুল কিবরিয়া
সঞ্জয় বাড়ু একজন অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের একজন উপদেষ্টা।
প্রথম আলো থেকে নেওয়া।