আশ্বিনের ১২ তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তিস্তা নদীতে হঠাৎ করে খুব বেশি পানির চাপ দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানির চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে ডুবে সয়লাব হয়ে গেছে তিস্তা নদীর দুই পাড়ের বহু বাড়িঘর, আবাদি জমি, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। জলকপাট খুলে দিলেই হঠাৎ বন্যা শুরু হয় এবং বন্ধ করে দিলে পানির সাথে আসা পাহাড়ি বালু জমা হয়ে একদিকে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়।
অন্যদিকে বড় বড় চর জেগে ও আবাদি জমিতে নতুন খসখসে বালু স্তূপীকৃত হয়ে চাষাবাদের অনুপুযুক্ত হয়ে পড়ে। সেখানে রবিশস্য আবাদ করাও দুষ্কর হয়ে যায়। দিগন্তবিস্তৃত বালুভর্তি নদীতট ও বিরাণভূমি বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে থাকে। বালুচরে ‘স্যান্ডসার্ফিং’ করে প্রান্তিক কৃষকরা জীবন বাঁচানোর উপায় খুঁজে হণ্যে হয়ে বেড়ায়। এরা আমাদের দেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত হলেও যুগ যুগ ধরে তাদের জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে না।
এ ধরনের বন্যা নদী তীরবর্তী মানুষগুলোর জীবনে প্রতি বছরের বহু করুণ ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। ছবি তোলা হয়, ভিডিও তৈরি হয়, টিভি, ইউটিউবে সেগুলোর দুর্দশার ছবি প্রচারিত হয়। গোটা দেশের মানুষের সাথে বিদেশিরাও সেসব ছবি দেখে শুধু ‘আহারে’ বলে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। সরকারি কর্মচারীরা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরুপণ করে লিখে নিয়ে যান। রাজনৈতিক নেতারা আশ্বাস দেন এই তো সামনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা আসছে। আরেকটু অপেক্ষা করুন।
গ্রীষ্মকালে তিস্তা নদীর বালুচরে স্যান্ড সার্ফিং করে আর কতকাল ধুলোবালি মেখে ঘরে ফিরবে সেখানকার ভুক্তভোগী মানুষজন? আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আর নতুন কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হোক তা শুনতে ও সহ্য করতে চাই না। সামনের দিনগুলোতে আর কখনই আমরা তিস্তার ধু ধু বালুচরে চরে ‘স্যান্ড সার্ফিং’ করে সময় নষ্ট করতে চাই না। তরুণ প্রজন্মের গঠনমূলক অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক নদী তিস্তাসহ দেশের সব নদীর পানি বৈষম্যের আশু অবসান হোক।
কিন্তু সেই অপেক্ষার পালা আর শেষ হতেই চায় না। প্রতিবেশী ভারতের একান্ত বন্ধুপ্রতিম সরকার তিন তিনবার ক্ষমতায় এসেছিল। তবুও তিস্তা পুনরুজ্জীবন করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে বহু চেষ্টা তদবির আলোর মুখ দেখেনি। তিস্তাপাড়ের মানুষ অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে দিন গুজরান করার পর শেষ পর্যন্ত চরম হতাশার মধ্যে ডুবে গেছে।
ইতোমধ্যে তরুণদের প্রচেষ্টায় এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ফসল হিসেবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মাথায় দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে সীমান্তের ওপাড় থেকে আসা উজানের ঢলে এক প্রলয়ঙ্কারি বন্যা বয়ে গেছে। এর ক্ষত শুকানোর চেষ্টা করা হলেও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য তা সহজে পুষিয়ে ওঠার মতো নয়।
এরই মাঝে বার বার অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে দেশের বড় বড় শহরের রাস্তা-ঘাট, সারাদেশের আবাদি জমির ফসল। ঘন ঘন বন্যার কারণে বীজতলা পচে যাওয়ায় আমন ধানের চারা লাগানো সম্ভব হয়নি বহু জেলায়। শুধু দেশের উত্তরাঞ্চলের ওপর ভরসা করে আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার হিসাব কষা হচ্ছে। সেই উত্তরের নদ-নদীতে কৃত্রিম বন্যার কারণে আমন আবাদের হিসেবে গরমিল শুরু হয়েছে।
এবার আশ্বিনে তিস্তা নদীতে নতুন করে বান ডেকেছে। একই সাথে পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়ায় হু হু করে বানের পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ধানের চারা।
একটানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলের কারণে রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের চরাঞ্চল ছাড়াও কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত দুদিনে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ রাস্তাঘাট, কৃষকের ধান, বাদাম, বেগুন, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। একটি দৈনিক পত্রিকায় বলা হয়েছে, “লালমনিরহাট সদর উপজেলার কালমাটির বাসিন্দা কৃষক রফিকুল ইসলাম (৫০) বলেন, দুদিন ধরে বাড়িতে পানি ওঠায় চুলা জ্বালাতে পারছি না। তাই খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। দিনে একবার রান্না করাই কষ্টকর। একই এলাকার নদী তীরবর্তী বাসিন্দা মজিবর রহমান (৫২) বলেন, দুদিন ধরে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির ভয়ঙ্কর শব্দে রাতের ঘুম হারিয়ে যায়। গত রাতে তার প্রতিবেশীর বাড়ির একটি ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্ধন এলাকার বাসিন্দা আফজাল হোসেন (৫৫) বলেন, তিস্তার ভয়াল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে গত ১৫ বছরে কতজন এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। এখন তিস্তায় পানি বাড়লেই আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে।”
এসময় উজানের পানিতে বয়ে আসে পাহাড়ি বালুকণা। বালুতে ডুবে যায় উর্বর জমি। সেসব জমিতে নতুন করে চর পড়ে যায়। ফসলের আবাদ দূরে থাক, সহসাই সেসব জমিতে ঘাসও জন্মায় না।
এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভারত বার বার পানি ছেড়ে দিয়ে ঘন ঘন বন্যা সৃষ্টি করছে। এমনকি আশ্বিনের বন্যা নয়- গত বছর চৈত্র মাসেও বন্যা হয়েছিল।
এর কারণ অনুসন্ধান করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে চীনের হোয়াংহো নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে তিস্তা পুনরুজ্জীবন করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে বহুদিনের আশা যখন আলোর দিকে তখন চীন ও ভারতের মধ্যে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ চরম ক্ষতির শিকার হলেও ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে সেখানে অনেকটা অসহায়। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী। যার ওপরে ভারতের সিকিম ও আসাম অঞ্চলে অনেকগুলো জলবিদুৎ প্রকল্প রয়েছে। আরও রয়েছে মহানন্দা ও হুগলীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কলকাতা বন্দরের নাব্য রক্ষার জন্য তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে সেদিকে নিয়ে যাওয়ার কৃত্রিম চ্যানেল।
যখন তিস্তার উজানে বান ডাকে, অতিবৃষ্টি হয়ে সয়লাব হয়ে যায় শুধু তখনই অতিরিক্ত পানির চাপ সামাল দিতে না পেরে বাংলাদেশের দিকে গজলডোবার জলকপাট খুলে পানি ছেড়ে দেওয়া হয় আর এটাই আমাদের দেশের মানুষের জন্য বার বার সর্বনাশ ডেকে আনে! আমাদের জন্য এটাই তিস্তা বিপর্যয়। এটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তাপাড়ের কোটি কোটি মানুষের জন্য।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান খুব তৎপর রয়েছেন একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে। কিন্তু সম্প্রতি শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবস্থান করছেন, যা উভয় দেশের সম্পর্ক শীতল করার জন্য বড় উপাদান হিসেবে কাজ করছে। এমন বিব্রতকর সময়ে কি তিস্তা নিয়ে কোনো বৈঠক কার্যকরী করা সম্ভব হবে?
এই মুহূর্তে বিশ্বসমাজের দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে। নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উন্নয়ন দর্শন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যতটা না কাজে লেগেছে তার চেয়ে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর কল্যাণে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার একই সঙ্গে সূচিত করতে হলে যে প্রেক্ষাপট তৈরি করা দরকার সেজন্য প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে ভারতের উদারতা প্রয়োজন। কিন্তু ভারত সেটা না করে বিভিন্ন দিক দিয়ে শুধু নিত্যনতুন সমস্যা তৈরির উপাদান ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
এমতাবস্থায় তাহলে তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান কি করে হবে? তাই কারও মুখাপেক্ষি হয়ে না থেকে আমার অংশের তিস্তা দিয়ে আমি কি করতে পারি- সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ, বর্ষায় বার বার জলকপাট ছেড়ে দেওয়া বন্যা, আশ্বিনে বন্যা, চৈত্রে বন্যা আর সহ্য করার মতো নয়।
প্রতি বছর দেশের উত্তরে বন্যা, পশ্চিমে বন্যা, পূর্বে বন্যা- যখন তখন বন্যার তোড়ে ভেসে যাওয়া কি আমাদের নিয়তি হয়ে থাকবে? শীত ও গ্রীষ্মকালে তিস্তা নদীর বালুচরে স্যান্ড সার্ফিং করে আর কতকাল ধুলোবালি মেখে ঘরে ফিরবে সেখানকার ভুক্তভোগী মানুষজন? আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আর নতুন কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হোক তা শুনতে ও সহ্য করতে চাই না। সামনের দিনগুলোতে আর কখনই আমরা তিস্তার ধু ধু বালুচরে চরে ‘স্যান্ড সার্ফিং’ করে সময় নষ্ট করতে চাই না। তরুণ প্রজন্মের গঠনমূলক অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক নদী তিস্তাসহ দেশের সব নদীর পানি বৈষম্যের আশু অবসান হোক।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।