২৩ সেপ্টেম্বরের সমকালে দাদন ফকির পুলিশে ঢুকেই ‘বাদশাহ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে সেই পুরোনো প্রবাদ ‘চোরের দশ দিন, সাধুর এক দিন’ মনে পড়ল। মনে পড়ার কারণ, প্রতিবেদনে বর্ণিত অসাধু ওই পুলিশ সদস্যকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের সময় তিনি আমাদের থানা শ্রীনগরে (মুন্সীগঞ্জ) এসআই পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ছিল বিস্তর অভিযোগ। মানুষকে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, সাহায্যের জন্য থানায় আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়; ব্যবসায়ী, বিশেষ করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মাদক কারবারিদের কাছ থেকে বখরা আদায় ইত্যাদি অপকর্ম চালাচ্ছিলেন তিনি। আমি তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। এলাকাবাসী অভিযোগ করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছিলাম না। কারণ, দাদন ফকিরের ক্ষমতার দড়িটি বাঁধা ছিল একটি শক্ত খুঁটির সঙ্গে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ কয়েক ব্যক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে এলাকার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ তুলতে থাকেন দেদার। কিন্তু বাতাস একদিন ঘুরে যায়। ২০০২ সালের ২২ জুন ওই রাষ্ট্রপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। জেলা পুলিশ সুপার ডা. লোকমান হাকিমকে বলে তাঁকে বদলি করাই। আসলে চাক্ষুষ সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে এর চেয়ে বড় কোনো শাস্তি তখন দাদন ফকিরকে দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
সেই দাদন ফকির অবশেষে বাধ্যতামূলক অবসর পেলেন। প্রতিবেদনমতে, রাজধানী ঢাকায় রয়েছে তাঁর ছয়তলা একটি বাড়িসহ নিজ এলাকা মাদারীপুরে একাধিক বাড়ি, জমি, প্লট ও মার্কেট। একজন মধ্যম সারির পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে এত সম্পদ অর্জন করলেন– অনেকের কাছে তা বিস্ময়কর হলেও আমার তা মনে হয় না। কারণ, দুর্নীতির সাগর-মহাসাগরে বিচরণরত তিমি, হাঙর, কুমিরের তুলনায় দাদন ফকির এক চুনোপুঁটি। যেখানে গত ১৫ বছরে অনেক সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রী, নেতা-পাতিনেতা, হাফ নেতা, কোয়ার্টার নেতা হাজার হাজার কিংবা শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন, সেখানে এএসপি দাদন ফকিরের সম্পদকে ‘সমুদ্রে গোস্পদ মাত্র’ বলেই অভিহিত করা যায়।
বস্তুত আমরা যদি সদ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের কালতামামি করতে যাই, তাহলে এ মুদ্দতকে ‘দুর্নীতির স্বর্ণযুগ’ বলাই শ্রেয়। কেননা, এই সময়ে দুর্নীতির ছোঁয়া লাগেনি এমন কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব, পদস্থ কর্মকর্তা, এমনকি পিয়ন-দারোয়ান পর্যন্ত সবাই দুর্নীতির ডোবায় হাবুডুবু খেয়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের পাহাড়। যেন এক আধুনিক আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন তারা, যাতে ঘষা দিলেই দৈত্য এসে বেলুনের মতো ফুলিয়ে দিয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক ব্যালান্স, তৈরি করে দিয়ে গেছে বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়ি। বস্তুত আলাদিনের সে চেরাগটি ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা। এর কাছাকাছি যারা ছিলেন, তারা নিজেদের ভাগ্যকে ঘুরিয়ে নিতে পেরেছেন কায়দামতো।
সব সরকারের আমলেই কিছু মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো’ কত কপর্দকহীন ভবঘুরে যে কোটিপতি বনে গেছে, তার হিসাব নেই। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরীর কথা উল্লেখ করা যায়। পাবনার একটি স্কুলে স্বল্প বেতনের শিক্ষিকা ছিলেন। বেতন পেতেন সাকল্যে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁর ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘুরে যায়। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর রাতারাতি মালকিন বনে যান বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে দুনিয়ায় জান্নাত তৈরি করা জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা।
জান্নাত আরা হেনরী কিংবা এসআই দাদন ফকিররা কীভাবে ফকির থেকে রাজা-রানীতে পরিণত হয়েছেন, তা বোধ করি কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একজন অধঃস্তন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যখন দেখেন তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গো-গ্রাসে ঘুষ গিলছেন, তখন তিনিও একই অপকর্মে উদ্বুদ্ধ হন।
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং-বদলির জন্য বস্তায় করে ঘুষ নিতেন। কমিশনার পদে রেট ছিল ৫ কোটি টাকা। তার পরদিন পত্রিকার খবরে বলা হয়, পিতার ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পুত্র জ্যোতি এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। খবরে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব পোস্টিং-ট্রান্সফার নাকি কামালপুত্রের সম্মতি ছাড়া হতো না। এ জন্য সবাই তাঁকে তুষ্ট রাখতেন নগদ নারায়ণ অর্ঘ্য দিয়ে। দাদন ফকিরও হয়তো সে তালিকাভুক্ত।
স্বয়ং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দু’হাতে লুটে নিয়েছেন রাষ্ট্রের তহবিল। ১৭ আগস্ট একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে সালমান এফ রহমানকে ‘লুটপাটের মাস্টারমাইন্ড’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। মুম্বাই ফিল্মের পর্দা কাঁপানো একজন হিরোর নাম ‘সালমান খান’। আমাদেরও একজন নায়ক ছিলেন ‘সালমান শাহ’, যিনি ১৯৯৭ সালে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের মানুষ সালমান খানকে নিয়ে গর্ব করেন। বাংলাদেশের মানুষ আজও সালমান শাহকে স্মরণ করেন তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্য। তবে আলোচ্য সালমান আজ নিন্দিত, ধিকৃত তাঁর কুকর্মের জন্য।
চীনা প্রবাদে আছে, ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’। তেমনি একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের পচন বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শুরুটা শীর্ষদেশ থেকেই শুরু হয়। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্র ও সমাজদেহের সর্বত্র। দাদন ফকির, জান্নাত আরা হেনরী, সালমান এফ রহমান, আসাদুজ্জামান কামাল ও তাঁর পুত্র জ্যোতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দেশবাসীর প্রত্যাশা– এই লুটেরা গংয়ের উপযুক্ত শাস্তি হোক, যাতে এ ধরনের ব্যক্তির আর উত্থান না হয়।
মহিউদ্দিন খান মোহন : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক