যদি বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনটি? সর্বসম্মতিক্রমে উত্তরটি হবে ‘ফেসবুক’।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যানালিটিকস প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে বর্তমান ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০০, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশেরও বেশি।
একটা সময় ছিল, যখন ফেসবুকের কার্যক্রম কেবল সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার গণ্ডি ছাপিয়ে ক্রমেই ফেসবুক হয়ে ওঠে মানুষের কাছে সংবাদমাধ্যম, বিনোদনমাধ্যম কিংবা ভার্চুয়াল জগতে ব্যবসার আর আয়–রোজগারের উৎস।
সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটি জনপ্রিয়তা লাভ করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে। মানুষের মন আর মগজকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আজ মহাসমারোহে রাজত্ব করছে ফেসবুক।
তবে বেশ কয়েক বছর হলো সামাজিক এ যোগাযোগমাধ্যমটি এমনভাবে বাণিজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে যে এখান থেকে বিদায় নিতে শুরু করেছে সুস্থ রুচি আর ইতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলো।
সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আকর্ষণ আর সহজে অর্থ উপার্জনের নিম্নগামী রুচির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার খাচ্ছে সুস্থ চিন্তা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আর রুচিশীল বিনোদন।
ফলে হতাশায় ভুগে অনেকেই নিজেদের সরিয়ে ফেলছেন এই মাধ্যম থেকে কিংবা নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকছেন। দিন দিনই যেন সুবৃহৎ এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি নোংরা রুচির প্ল্যাটফর্মে পরিণত হচ্ছে। সাড়ে ছয় কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে ফেসবুক বর্জনকারী কিংবা নীরব ব্যবহারকারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
তাঁদের অনুপস্থিতি চট করে বোঝা না গেলেও একসময় তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অনুভূত হয় প্রতিবাদবিহীন নোংরা মন্তব্যের ভিড়ে।
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ আর হয়রানির কথা আমাদের অজানা নয়।
স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারার হতাশা থেকেও সেসময় অনেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন এই প্ল্যাটফর্ম থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পথপরিক্রমায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি যেদিকে যাচ্ছে, সেটিও কাঙ্ক্ষিত ছিল না মোটেই।
বাক্স্বাধীনতার অর্থ কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে এখানে যার যা খুশি তা–ই বলছে, যার যা খুশি তা–ই করছে। যা খুশি তা–ই প্রচার আর প্রসারের এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ পাতাই দায় হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান এবং আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে ফেসবুক নামক প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে নতুন এক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই আশাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যখন আন্দোলন–পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা এ মাধ্যমটিকে নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
আফসোস, এত বড় একটা মাধ্যমকে দেশের বৃহত্তর কোনো কল্যাণে তেমনভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না, গণমানুষকে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না। ফেসবুক আজকাল পরিণত হয়েছে মোরাল পুলিশিং, মব জাস্টিস, আর সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের এক মাধ্যমে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞাপনগুলোতে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ কিংবা নৈতিকতার প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে ওঠা সস্তা সংবাদ শিরোনাম, মনগড়া খবর, বানোয়াট ভিডিওগুলো সত্য–মিথ্যা যাচাইয়ের আগেই ছড়িয়ে পড়ছে। ভিউ আর সংখ্যার বাণিজ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ আর মূল্যবোধ।
‘যত ভিউ, তত বাণিজ্য’—এটিই যেন টিকে থাকার মূলমন্ত্র। ফেসবুক আজকাল অসত্য আর নোংরা কথা, কার্যকলাপ আর বিজ্ঞাপনের মহোৎসবে পরিণত হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তাই এর গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এখন খুব প্রয়োজন এই মাধ্যমটিতে শুভশক্তির দৃশ্যমান উপস্থিতি; যাঁরা দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে, মানবতা নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভাবেন।
যাঁরা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে জানেন, বোঝেন, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে নির্ভয়ে কথা বলতে পারেন। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, নিজেদের আর দূরে সরিয়ে রাখবেন না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে খুব প্রয়োজন শুভ শক্তির উত্থান।
তাই ফিরে আসুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, নীরবতা ভেঙে কথা বলুন। ছড়িয়ে দিন শুভশক্তি, রুখে দিন নোংরা আর অসত্যের মুখোশ। যা কিছু অন্যায় তার বিরুদ্ধে কথা বলুন, আওয়াজ তুলুন। আমাদের সমন্বিত শুভর চর্চায় আসুক নবজাগরণ। নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখা কোনো সমাধান নয়।
আমাদের নীরবতার সুযোগে মিথ্যা ছড়িয়ে পড়ছে আর রুচিহীনতা মহামারির রূপ ধারণ করছে এবং তা প্রজন্মকে গ্রাস করে ফেলছে। মিথ্যা তার জৌলুশ দিয়ে হয়তো অনেক কিছুই সাময়িকভাবে ভুলিয়ে রাখে।
তবে জৌলুশ হারিয়ে গেলে সত্যের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে টের পাওয়া যায়। তাই অনুরোধ, ফিরে আসুন। নবজাগরণ হোক সত্য আর সুন্দরের।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]
* প্রথম আলো থেকে নেওয়া