ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের রাজনীতি: কার লাভ কার ক্ষতি

শেখ ওমর  
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ২২:৩৩

গত বুধবার (২৩ অক্টোবর ২০২৪) ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ঘোষণার রাজনৈতিক তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই সন্ত্রাস ও গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ আরও অনেকে। সেই দাবির প্রাথমিক বিজয় হলো ছাত্রলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞায়।

 বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে বোকা বানানো তো দূরে থাক, তাদেরকে তাদের আকাঙ্ক্ষা-পূরণ থেকে বেশি দিন আটকে রাখাও সম্ভব নয়। নতুন এই নেতৃত্বের চোখে ধুলা দিয়ে যারা দিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খোয়াব দেখছেন, বাংলার অদম্য ছাত্র-শ্রমিক-জনতার কাছে তাদের পরাজয়ও অবশ্যম্ভাবী। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের মাধ্যমে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রাথমিক বিজয় তো হলো, পরিপূর্ণ বিজয়ও বেশি দূরে নয়। 

অভ্যুত্থান বা বিপ্লবে পতিত অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার নজির ইতিহাসে অনেক আছে। জার্মানির নাৎসি পার্টি (National Socialist German Workers' Party) এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে নাৎসি প্রতীকের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি, যেটার নেতৃত্বে ছিল বেনিটো মুসোলিনি, নিষিদ্ধ করা হয়। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসন শেষ হওয়ার পর ১৯৪৩ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ইতালির সংবিধানের ১২তম অনুচ্ছেদে ফ্যাসিস্ট দলের পুনর্গঠন নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়, যেখানে আনুমানিক ৮ লাখ তুতসি ও সংখ্যালঘু হুতু নাগরিকদের হত্যা করা হয়। এই গণহত্যা সংগঠিত করতে মূলত দায়ী ছিল Interahamwe নামের একটি হুতু মিলিশিয়া গ্ৰুপ, যেটি ছিল রুয়ান্ডার তৎকালীন শাসক দলের যুব সংগঠন। গণহত্যার পর ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে রুয়ান্ডায় নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই Interahamwe ও গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। গণহত্যার সময় যেসব সংগঠন সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল বা প্ররোচনা দিয়েছিল, তাদের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করে ১৯৯৫ সালে "Rwandan Penal Code"-এর সংশোধনী আনা হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের সংবিধানে গণহত্যাবিরোধী ও বিভাজনমূলক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণের জন্য বিশেষ ধারা যুক্ত করা হয়। এছাড়াও Gacaca Courts নামে পরিচিত বিশেষ বিচার-প্রক্রিয়া চালু করে গণহত্যায় জড়িত মিলিশিয়া সদস্য ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালিত হয়। এর পাশাপাশি ২০০৮ সালের Rwandan Law on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide Ideology-তে গণহত্যার আদর্শ প্রচার ও সহিংসতা উসকে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

নেপালে ২০০৬ সালে "লোকতন্ত্র আন্দোলন" নামে পরিচিত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। ২০০৭ সালে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যা রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে এবং রাজতন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০০৮ সালে নেপালকে আনুষ্ঠানিকভাবে "গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র" ঘোষণা করা হয় এবং সংবিধানে রাজতন্ত্র সমর্থিত সকল সংগঠনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৫ সালে নেপালে গৃহীত নতুন সংবিধানে দলীয় কাঠামোয় প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সমর্থক কোনো সংগঠনকে পুনর্গঠন বা রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকারের সমর্থক সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ব্যবহার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ১৯৪৫ সালে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তির অধীনে আসে। জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের নেতৃত্বে মিত্রশক্তির প্রশাসন (Supreme Commander for the Allied Powers, SCAP) জাপানের পুনর্গঠন এবং সামরিক বাহিনীর উগ্র নীতি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়। SCAP-এর মূল লক্ষ্য ছিল জাপানের সামরিক শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঠেকানো এবং ভবিষ্যতে জাপানের তরফ থেকে কোনো সামরিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করা। ১৯৪৭ সালে জাপানের নতুন সংবিধান (যা "ম্যাকআর্থার সংবিধান" নামে পরিচিত) কার্যকর হয়। সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদ (Article 9) অনুযায়ী, জাপান স্থায়ীভাবে যেকোনো ধরনের যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে এবং তাদের আর কোনো স্থায়ী সামরিক বাহিনী থাকবে না। এই সংবিধানের মাধ্যমে জাপানে যে-কোনো সামরিকতাবাদী কার্যকলাপকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে সামরিকতাবাদী আদর্শ প্রচারকারী, সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনকারী বা সামরিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্যে কাজ করা সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। জাপানের স্কুল পাঠ্যক্রমে সামরিকতাবাদী প্রচারণা ও শিক্ষা পরিবর্তনের জন্য নতুন নীতিমালা চালু করা হয়। জাপানে প্রচলিত সামরিক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়।

২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসনের পর ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ইরাকের নতুন সরকার বাথ পার্টির সব ধরনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে এবং বাথ পার্টির নেতাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়। সাদ্দামসহ শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
২০১১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর হামলা ও গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। গাদ্দাফির পতনের পর ২০১২ সালে লিবিয়ায় মার্কিন সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদ (National Transitional Council - NTC) গাদ্দাফির সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তার দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নতুন প্রশাসন একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল গাদ্দাফির শাসনকালের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিলুপ্তি। বিশেষত ২০১২ সালে "Political Isolation Law" (রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আইন) নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, গাদ্দাফি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি বা দলের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইনটি কার্যত গাদ্দাফির সমর্থক দল বা সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে।
বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলনে হাজার হাজার বার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল: "দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা।" এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্পিরিট ছিল দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে দাবি ওঠে দিল্লির দাস আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। বাংলাদেশে মার্কিন সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার পতিত স্বৈরাচারের সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করবে—এটাই ছিল সবচেয়ে প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি কথিত ইসলামপন্থী দল হঠাৎ করে প্রকাশ্যেই দিল্লির সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ ছাত্র-জনতার মৃত্যুর মিছিল থেমে যাওয়ার আগেই গত ২৮ আগস্টে সেই দলটির প্রধান হুট করে ঘোষণা দিয়ে দেন যে, দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর তাঁর ক্ষোভ নেই এবং তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন! ৩ সেপ্টেম্বরে ওই একই নেতা বলেন, তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে তিনি যদিও পরে সেই ক্ষমার ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা দেন, কিন্তু ওই কথিত ইসলামপন্থী দলটি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষেই রয়ে যায়। গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর ২০২৪) ঢাকার একটি ভারতপন্থী ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সেই দলটির প্রধান স্পষ্টভাবেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন।
একইভাবে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও গত ২৮ আগস্টেই প্রকাশ্যে বলেছেন তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে নন।
৩০ আগস্টে ডেইলি স্টার -এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে নন।

যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্বৈরাচার/ফ্যাসিবাদ পতনের পর শুধু ওই দলগুলোই নিষিদ্ধ হয়নি, নিষিদ্ধ হয়েছে সেসব দলের আদর্শ ও প্রতীক, এমনকি সংস্কার করা হয়েছে ওইসব দলের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা, সেখানে বাংলাদেশে দিল্লিপন্থী মিডিয়া ও ভারতের মন পেতে ব্যাকুল এক শ্রেণির রাজনীতিবিদের কারণে পতিত ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা গেল না। নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের "ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন" ছাত্রলীগকে। এবং এই নিষেধাজ্ঞাটিও আরোপ করা হয়েছে বিতর্কিত "সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯"-এর অধীনে।

বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনগুলো হলো নাইন ইলেভেন পরবর্তী বিশ্বে মার্কিন-ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন তথাকথিত "ওয়ান অন টেরর"-এর অংশ। টুইন টাওয়ারে হামলার পরের মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে Terrorism (USA PATRIOT) Act, 2001 পাস করা হয়। তার পরের মাসে ব্রিটেনে জারি করা হয় Anti-terrorism, Crime and Security Act, 2001.

এই আইনগুলোর আদলে দেশে দেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করার জন্য মার্কিন-ব্রিটিশ চাপ তৈরি করা হয়। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারত এই ধরনের সন্ত্রাস বিরোধী আইন পাস করে। বাংলাদেশে তৎকালে ক্ষমতাসীন চার দলীয় জোট সরকারের ওপরেও চাপ ছিল এই ধরনের সন্ত্রাসবিরোধী আইন তৈরি করার। কিন্তু বিএনপি জোট সরকার ওই আইন প্রণয়নে অগ্রসর হয়নি। বিএনপি জোটের ওপর তখন পশ্চিমা বিশ্বের নাখোশ হওয়ার এটি ছিল অন্যতম কারণ।
পরবর্তীতে মার্কিন-ভারতের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতায় এসে "সন্ত্রাস বিরোধী অধ্যাদেশ, ২০০৮" জারি করে। ওয়ার অন টেরর-এ মার্কিন-ভারতের সহযোগী হিসেবে ২০০৯ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ ওই "সন্ত্রাস বিরোধী অধ্যাদেশ, ২০০৮"-কে আইনে পরিণত করে। অর্থাৎ হুবহু সেই অধ্যাদেশের আলোকে সংসদে "সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯" পাস করা হয়।

মার্কিন, ব্রিটিশ ও ভারতীয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আদলে বাংলাদেশে এই আইনটি বানাতে গিয়ে আইনটিতে অনেক গুরুতর অসঙ্গতি, দুর্বলতা ও ফাঁক-ফোকর রয়ে যায়। ফলে ২০১২ ও ২০১৩ সালে আইনটিতে দুটি সংশোধনী আনা হয়। ২০১৩ সালের সংশোধনীর প্রতিবাদে ওই সময়ে সংসদে উপস্থিত বিএনপি এমপিগণ ওয়াকআউট করেছিলেন এবং বিএনপি ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ও কালো আইন বলেছিল। বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফার ১১ নং দফায় আছে: "সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯-এর প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে।"

অন্তর্বর্তী সরকার "সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯"-এর আওতায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মার্কিন-ভারতের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রণীত এই কালো আইনটির এক ধরনের বৈধতা দিয়ে দিল। অন্তর্বর্তী সরকার গত আড়াই মাসে অধ্য্যদেশের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আমলের আটটি আইন সংশোধন করলেও এই "সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯"-এ কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এখন এই আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার কারণে ভবিষ্যতে ক্ষমতা পেলে বিএনপির জন্যও এই আইনটি সংশোধন করা অনেকটাই দুরূহ হয়ে গেল। অর্থাৎ মার্কিন-ভারতের লাভ হলো, কিন্তু কালো আইন বাতিলের গণআকাঙ্ক্ষার ক্ষতি হলো।

ফ্যাসিবাদের মাথা আওয়ামী লীগকে না কেটে ফ্যাসিবাদের বিষফোঁড়া ছাত্রলীগকে ছেটে ফেলা হলো। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুনাখুনি, ধর্ষণসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছাত্রলীগ আসলে আওয়ামী লীগের জন্য একটি লায়াবিলিটিতে পরিণত হয়েছিল। এখন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ক্লিন ইমেজের আরেকটি আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখার ভারতীয় যে পরিকল্পনা, সেটিরই বরং লাভ হলো। ফ্যাসিবাদ নির্মূলের জন্য আবু সাঈদ-মুগ্ধ-ওয়াসিমদের যে স্বপ্ন ছিল, সেটার ক্ষতি হলো।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণের দাবিতে সোচ্চার ছাত্র সমন্বয়কেরা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার সংবাদে মিষ্টি খেয়ে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটাচ্ছেন। বড় দলগুলোর বহুরূপী রাজনীতির কাছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের স্পিরিট হোঁচট খেল।

৫ আগস্টের আগে জাতির সামনে উলঙ্গ হয়ে যাওয়া জাহাঙ্গীর কবির নানক তাই সাদা পাঞ্জাবি পরে ক্যামেরার সামনে এসে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে "ফ্যাসিস্ট" বলতে পারছেন, আন্দোলনকারী ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে হিযবুত তাহরীর-জামায়াত-শিবির-কিশোর গ্যাং ইত্যাদি তকমা দিচ্ছেন। হাসিনা-নানকদের এই অসভ্যতা ও জঘন্য মিথ্যাচারের "রাজনীতি" নিষিদ্ধ করার বিপক্ষেই তো ছিল বাংলাদেশের দিল্লিপন্থী মিডিয়া ও ভারতের মন পেতে ব্যাকুল এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ?
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের বিরোধিতাকারী এই শ্রেণির মিডিয়া ও রাজনীতিবিদেরাই উলঙ্গ নানককে সাদা পাঞ্জাবিটি দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে বোকা বানানো তো দূরে থাক, তাদেরকে তাদের আকাঙ্ক্ষা-পূরণ থেকে বেশি দিন আটকে রাখাও সম্ভব নয়। নতুন এই নেতৃত্বের চোখে ধুলা দিয়ে যারা দিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খোয়াব দেখছেন, বাংলার অদম্য ছাত্র-শ্রমিক-জনতার কাছে তাদের পরাজয়ও অবশ্যম্ভাবী। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের মাধ্যমে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রাথমিক বিজয় তো হলো, পরিপূর্ণ বিজয়ও বেশি দূরে নয়।