আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ফাতেমার (রা.) জন্ম হয়েছিল ইসলামের আবির্ভাবের পাঁচ বছর আগে মক্কায় হজরত খাদিজার (রা.) গর্ভে। নবিজি (সা.) যখন নবুয়্যত লাভ করেন, তখন হজরত খাদিজাসহ (রা.) নবিজির (সা.) সব সন্তানরা ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত ফাতেমাও (রা.) তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন।
নবিজির (সা.) মদিনায় হিজরতের সময় ফাতেমা ও উম্মে কুলসুম (রা.) মক্কায় ছিলেন। কিছুদিন পর নবিজি (সা.) একজন সাহাবিকে পাঠান তাদের নিয়ে যেতে। তারা তার সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেন।
হিজরতের দ্বিতীয় বছর রমজান মাসে হজরত ফাতেমার (রা.) বিয়ে হয় নবিজির (সা.) সন্তানতুল্য চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবি তালিবের (রা.) সঙ্গে। জিলহজ মাসে তারা একসঙ্গে সংসার করা শুরু করেন। তাদের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন হাসান, হোসাইন, জয়নব, উম্মে কুলসুমের (রা.)। তাদের ছোট সন্তান মুহসিন ছোটবেলায় ইন্তেকাল করেন।
নবিজির (সা.) মেয়েদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। নবিজির (সা.) ইন্তেকালের সময় হজরত ফাতেমার বয়স ছিল মাত্র আটাশ বছর।
নবিজির (সা.) ইন্তেকালের সময় তার সন্তানদের মধ্যে শুধু ফাতেমাই (রা.) জীবিত ছিলেন। নবিজির (সা.) অন্য সব সন্তানের মৃত্যু হয়েছিল তার জীবনকালেই। নবিজির (সা.) ছেলেরা সবাই পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেই ইন্তেকাল করেন। নবিজির (সা.) তিন মেয়ে, উম্মে কুলসুম, রুকাইয়া ও যয়নব (রা.) পূর্ণবয়স্ক হয়েছিলেন। তারা সবাই মদিনায় হিজরতের পর নবিজির (সা.) জীবনকালেই ইন্তেকাল করেন। নবিজির (সা.) ইন্তেকালের ছয় মাস পর ১১ হিজরির ৩ রমজান হজরত ফাতেমাও (রা.) ইন্তেকাল করেন।
ফাতিমা (রা.) ছিলেন নবিজির (সা.) সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। তিনি ভালোবেসে তাকে ডাকতেন ‘উম্মু আবিহা’— অর্থাৎ, ‘তার বাবার মা’। কারণ ফাতেমার (রা.) অন্তরেও ছিল বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা ও দরদ। নবিজি (সা.) জানতেন, তার ইন্তেকালের শোক সহ্য করা ফাতেমার (রা.) জন্য কষ্টকর হবে। তিনি ইন্তেকালের আগেই ফাতোমাকে (রা.) জানিয়েছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করবেন আর তার ইন্তেকালের কিছুদিন পর ফতেমাও (রা.) ইন্তেকাল করবেন। নবিজির (সা.) পরিবারের মধ্যে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে নবিজির (সা.) সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হবে ফাতেমার (রা.)।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন ফাতেমা (রা.) নবিজির (সা.) কাছে এলেন। তার হাঁটার ভঙ্গি ছিল হুবহু রাসুলের (সা.) মতো। রাসুল (সা.) তাকে দেখে বললেন, ‘আমার কন্যা, স্বাগতম।’ এরপর তাকে তার ডান অথবা বাম পাশে বসালেন। তারপর তিনি তার কানে কিছু বললেন, এতে ফাতেমা কাঁদতে শুরু করলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল (সা.) তোমাকে গোপনে কী বললেন যে তুমি কাঁদছ? কিছুক্ষণ পর রাসুল (সা.) আবার তার কানে কিছু বললেন, এবার তিনি হেসে ফেললেন। আমি বললাম, আজকের মতো এত দ্রুত হাসি-কান্নার অদল-বদলের ঘটনা তো আগে দেখিনি। পরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কোনো গোপন কথা প্রকাশ করব না।
তবে রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের পর আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, রাসুল (সা.) আমাকে বলেছিলেন, জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর একবার কোরআন নিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, এবার তিনি দুইবার এসেছেন। আমি মনে করছি, আমার ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এ কথা শুনে আমি কেঁদেছিলাম। পরে নবিজি (সা.) আমাকে বললেন, তুমি আমার পরিবারের প্রথম ব্যক্তি, যে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তুমি কি খুশি নও যে, তুমি জান্নাতে মুমিন নারীদের সর্দার হবে? তখন আমি খুশি হয়ে হেসেছিলাম। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)
ইমাম বায়হাকির (রহ.) বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল (সা.) ইন্তেকালের পর যখন হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা হন, তখন তার সাথে একটি বিষয়ে ফাতেমার (রা.) মতপার্থক্য হয়। আবু বকরের (রা.) প্রতি তিনি কিছুটা অসন্তুষ্ট হন। পরে তিনি অসুস্থ হলে আবু বকর (রা.) তার কাছে যান, তার সঙ্গে কথা বলেন এবং নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, আমি সবকিছুই করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টি, রাসুলের (সা.) সন্তুষ্টি এবং আহলুল বায়েতের সন্তুষ্টির জন্য। তখন ফাতেমা (রা.) খুশি হন। মৃত্যুর সময় আবু বকরের (রা.) প্রতি তার রাগ ছিল না।
ইন্তেকালের আগে ফাতেমা (রা.) ওসিয়ত করেন, মৃত্যুর পর তাকে যেন গোসল দেন আসমা বিনতে উমাইস (রা.) যিনি তখন আবু বকরের (রা.) স্ত্রী ছিলেন। তার অসিয়ত অনুযায়ী আসমা (রা.) ও আলী (রা.) তাকে গোসল দেন। আলী (রা.) তার জানাজা পড়ান, আব্বাস (রা.) জানাজায় অংশ নেন। তাকে ১১ হিজরির ৩ রমজান রাতে দাফন করা হয়।
উম্মে রাফে (রা.) বলেন, ফাতেমা (রা.) যে অসুস্থতায় ইন্তেকাল করেন, ওই অসুস্থতায় আমি তার সেবা করতাম। একদিন সকালে আমি তাকে তার অসুস্থতার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় দেখলাম। সেদিন আলী (রা.) কোনো কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তখন ফাতেমা (রা.) আমাকে বললেন, মা! আমাকে গোসলের পানি এনে দাও।
আমি তার জন্য পানি এনে দিলাম। তিনি খুব সুন্দরভাবে গোসল করলেন। এর আগে আমি অসুস্থ অবস্থায় তাকে এত সুন্দরভাবে গোসল করতে দেখিনি। এরপর তিনি বললেন, আমার নতুন কাপড়গুলো দাও। আমি তাকে কাপড় দিলাম, তিনি তা পরিধান করলেন। তারপর তিনি বললেন, ঘরের মাঝখানে আমার বিছানাটা বিছিয়ে দাও। আমি বিছিয়ে দিলাম।
তিনি কেবলার দিকে মুখ করে এক হাত নিজের গালের নিচে রেখে শুয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, আমি এখন ইন্তেকাল করতে যাচ্ছি। আমি পবিত্র অবস্থায় আছি, তাই আমার শরীর যেন কেউ না খোলে। এরপর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ)