রাজসাক্ষী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ভাগ্যে খালাস নাকি সাজা

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৯

পুলিশের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার আমলেই সংঘটিত হয়েছিল চব্বিশের জুলাই গণহত্যা। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলন ঘিরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচার গুলি কিংবা নৃশংসতার যেন কোনো ইয়াত্তা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটতেই কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে তৎকালীন এই আইজিপির নাম। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আসামি হিসেবে থাকলেও দায় কাঁধে নিয়ে তিনি রাজসাক্ষী হয়ে যান। আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন নিজেরই একসময়ের কর্তা শেখ হাসিনা আর আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে। সামনে এনেছেন বহু অজানা তথ্য। সত্য উদঘাটনের বিনিময়ে কি তিনি খালাস পাচ্ছেন, নাকি পূর্ণ সাজা পাচ্ছেন— এমন জল্পনা অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে।
তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তিতর্ক শেষে এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায়। সেই দিনক্ষণ ঠিক হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে চূড়ান্ত ফলাফল। এ মামলায় হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড বা সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও, মামুনের শাস্তি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন। এমনকি তার অ্যাকুইটাল (খালাস) চেয়েছেন নিজের অর্থে নিয়োগ করা আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১০ জুলাই হাসিনা-কামাল-মামুনের বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে এ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। ওই দিন তাদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ পড়েন বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। তখন অনেকটা অনুতপ্তের ছাপ দেখা যায় আসামির কাঠগড়ায় থাকা মামুনের কপালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘দোষী নাকি নির্দোষ’— এমন কথা জানতে চাওয়া হয়। আদালতকে জবাব দিতে পকেটে রাখা এক টুকরো কাগজ দেখে বেশ জোরালো কণ্ঠে দায় স্বীকার করে নেন পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক।
‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হয়ে সবকিছু প্রকাশ করার কথাও জানান ট্রাইব্যুনালকে। ইংরেজিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আই প্লিড গিল্টি। আই অ্যাম উইলিং টু ভলান্টারি ডিসক্লোজ ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার অব দ্য হোল অব দ্য সারকামস্ট্যান্সেস উইদিন মাই নলেজ রিলেটিং টু দ্য ইনস্ট্যান্স কেস।’ যার বাংলায় অনেকটা এমন দাঁড়ায়— ‘আমি দোষ স্বীকার করছি। আমি স্বেচ্ছায় সত্য প্রকাশ করব। এ মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত আমার জানা সব পরিস্থিতির কথা তুলে ধরব।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর ডায়াসে দাঁড়িয়ে সব ফাঁস করে দেন চৌধুরী মামুন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যাযজ্ঞ ঘিরে শেখ হাসিনার সরকারের নীলনকশা, আন্দোলন দমনে ছক কষতে প্রতি রাতে আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় হওয়া বৈঠক, গ্যাং অব ফোরের সদস্যদের নামসহ অনেক অজানা তথ্যের ঝাঁপি খোলেন তিনি। মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি-উৎসাহী ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে নিয়েও দেন বিস্ফোরক তথ্য।
ডিএমপির এই সাবেক কমিশনার ও এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দুটি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল বলেও জবানবন্দিতে জানিয়েছেন মামুন। এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে আনার প্রস্তাবদাতাদের নাম, হেলিকপ্টার-ড্রোন ওড়ানো, র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল কিংবা আয়নাঘরখ্যাত গোপন বন্দিশালায় বিরোধী মতাদর্শের লোকদের তুলে নিয়ে নির্মমতার বিবরণও তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালের সামনে। এমনকি গোপালগঞ্জ বলয় দ্বন্দ্ব ঢাকতে আইজিপি পদে নিজের মেয়াদ পরপর দুবার বাড়ানো হয় বলেও জানান তিনি। সবশেষ পুলিশে ৩৬ বছরের কর্মজীবনের কথা টেনে গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার-আহতসহ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চান এই রাজসাক্ষী।
সূত্রমতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮ স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। ৫০-এরও বেশি জেলায় ব্যবহৃত হয় মারণাস্ত্র। গুলি ছোড়া হয়েছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। শুধুমাত্র ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল ঢাকায়। মানুষের প্রাণ কাড়তে ব্যবহৃত হয়েছিল এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলভারসহ অন্যান্য অস্ত্র। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে সবচেয়ে বেশি গুলি চালানোর অভিযোগ পুলিশের দিকে। নিজের মেয়াদকালে হওয়ায় এমন দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না সাবেক আইজিপি মামুন। কারণ, আন্দোলন দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের বাসায় নিয়মিত হওয়া সব ধরনের ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনার বৈঠকে তিনিও অংশ নিতেন। সেক্ষেত্রে বাকি অপরাধীদের মতোই তার সাজা হওয়া উচিত বলে মনে করেন কেউ কেউ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পেশাগত জীবনে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য আইজিপিদের চেয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। নিষ্ঠাবান হওয়ায় বাহিনীর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে পছন্দ করতেন। তবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে চাইলেই তিনি কিছু একটা করতে পারতেন। কারণ, পুরো বাহিনী তার অধীনে ছিল। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। বরং প্রধান হিসেবে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে অতি-উৎসাহী হয়ে ওঠেন অধস্তনরা। এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করে রাজসাক্ষী হয়ে যদি নিস্তার বা কম সাজা পান, তাহলে যারা গ্রেপ্তার রয়েছেন, তাদের মাঝে এক ধরনের প্রশ্ন জাগবে।
পেশাগত জীবনে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য আইজিপিদের চেয়ে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। নিষ্ঠাবান হওয়ায় বাহিনীর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে পছন্দ করতেন। তবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে চাইলেই তিনি কিছু একটা করতে পারতেন। কারণ, পুরো বাহিনী তার অধীনে ছিল। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। বরং প্রধান হিসেবে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে অতি-উৎসাহী হয়ে ওঠেন অধস্তনরা। এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করে রাজসাক্ষী হয়ে যদি নিস্তার বা কম সাজা পান, তাহলে যারা গ্রেপ্তার রয়েছেন, তাদের মাঝে এক ধরনের প্রশ্ন জাগবে
ট্রাইব্যুনালে দেওয়া মামুনের সাক্ষ্যে সত্য উন্মোচিত হয়েছে— দাবি প্রসিকিউশনের। রাজসাক্ষী হওয়ার সময় দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছেন বলেও মনে করেন তারা। নিজের অর্থে নিয়োগ করা আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদও একই সুরে কথা বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, “পুরোপুরি সত্য উন্মোচনের শর্তে শেখ হাসিনার মামলায় মামুনকে অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে ডিক্লেয়ার (ঘোষণা) করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সেই শর্ত পালন করলেই আইনে বর্ণিত সুবিধা পাবেন তিনি। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তার জবানবন্দি অবশ্যই ‘ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার’ ছিল। অর্থাৎ, শর্ত অনুযায়ী নিজের জ্ঞানে জানা সব কিছুই তিনি প্রকাশ করেছেন বিচারের স্বার্থে। এতে কোনো অত্যুক্তি বা কমতি ছিল না। কারণ, এ মামলায় যেসব সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন, তাদের পক্ষে এতটুকুই দেখা সম্ভব ছিল, যা তারা দেখেছেন কিংবা শুনেছেন। কিন্তু ভেতরের খবর তথা প্রশাসনিক দিক থেকে বা উপর মহলে যে ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল, সেসব এই সাক্ষীদের পক্ষে প্রিজুম করা সম্ভব নয়। চৌধুরী মামুন যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।”
সাজা পাবেন নাকি খালাস— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় অ্যাপ্রুভারের বিধান থাকলেও স্পষ্টভাবে বলা নেই পরিণতি কী হবে। ট্রাইব্যুনালে সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধি) প্রযোজ্য নয়। তবে, সিআরপিসিতে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যখন কাউকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হবে এবং আদালত সন্তুষ্ট হবেন যে, সে তার জানা সব সত্য উন্মোচিত করেছে, তখন তার পরিণতি হবে অ্যাকুইটাল বা খালাস। আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সুবিধা পেলে মামুনও খালাস পাবেন বলে আমার প্রত্যাশা।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ এর ১৫ ধারায় অ্যাপ্রুভারের বিধান থাকলেও স্পষ্টভাবে বলা নেই পরিণতি কী হবে। ট্রাইব্যুনালে সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধি) প্রযোজ্য নয়। তবে, সিআরপিসিতে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যখন কাউকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হবে এবং আদালত সন্তুষ্ট হবেন যে, সে তার জানা সব সত্য উন্মোচিত করেছে, তখন তার পরিণতি হবে অ্যাকুইটাল বা খালাস। আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সুবিধা পেলে মামুনও খালাস পাবেন বলে আমার প্রত্যাশা
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ
রাজনৈতিক কোনো দেনদরবার হয়েছে কি না— জানতে চাইলে মামুনের এই আইনজীবী বলেন, “দেনদরবারের প্রশ্নই ওঠে না। ট্রাইব্যুনালের সামনে তিনি ‘গিল্টি প্লিড’ করেছেন, আবেদন জানিয়েছেন। আমি তার আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ওপেন কোর্টে তার ‘গিল্টি প্লিড’ গ্রহণ করে তাকে শর্তসাপেক্ষে রাজসাক্ষী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। জবানবন্দিতে সব বলেছেন তিনি। এখন ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করবেন। সন্তুষ্ট হলে আইনের যে সুবিধা পাওয়ার হকদার, এর সর্বোচ্চটাই তিনি পাবেন। এছাড়া, বিচার স্বচ্ছভাবেই হচ্ছে।”
এ বিষয়ে অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেওয়া সাবেক আইজিপি মামুনের রাজসাক্ষী হওয়ার প্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনা করা যায়। পুলিশপ্রধান হিসেবে তিনি নানা ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়ও তার বক্তব্যের যে মনস্তত্ত্ব, তিনি কতটা ওই ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এসব কি নিজে থেকে দিয়েছেন না চাপে পড়ে দিয়েছেন— এ ধরনের একটা বিতর্ক রয়েছে। তবে, যেহেতু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে রাজসাক্ষী করা হয়েছে, তাই এক ধরনের দায়মুক্তির প্রসঙ্গ আইনগতভাবেই তৈরি হয়। এর মাধ্যমে সেই সময়ে কারা-কীভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কতটুকু জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পুলিশ যে কাজ করেছে— এসবের প্রকাশ ঘটেছে। এই প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাবেক এই আইজিপির ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, তা ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু যাদের নাম এসেছে, আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের বিচারের যে প্রসঙ্গ বা জবাবদিহিতার মধ্যে আনা, তা একেবারে অপরিহার্য।’
তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় আনা সূত্র ধরেই এসবের সমাধান প্রয়োজন। কোনো কিছু প্রতিরোধের জন্য যেন পুলিশ বাহিনীর ঘাড়ে বন্দুক রেখে কেউ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে না পারে। একইসঙ্গে পুলিশের অন্যান্য ইউনিট তথা ডিবি বা এসবি-র যারা মূল দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন, অর্থাৎ অতি-উৎসাহী হয়ে তারা যেসব কাজ করেছেন, তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ, একক কোনো পুলিশ একা এসব করতে পারে না। পুলিশে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ছিল, যারা রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই সত্যিকার অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। একইসঙ্গে এর পেছনের রহস্য উদঘাটন করতে হবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অগণতান্ত্রিক কোনো প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি করার যে বাস্তবতা, সেখানে যেন পুলিশ আর ভুক্তভোগী না হয়। এই বাহিনীর সুনাম বা পেশাগত অবস্থান যেন কোনো সংকটের মধ্যে না পড়ে, সেটি স্থায়ীভাবে সমাধান করা দরকার। এতে যারা অভিযুক্ত বলে বিবেচ্য হবেন, তাদেরই শুধু আইনের আওতায় আনতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশের কিছুটা দূরত্ব ও আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে। যদিও এই বাহিনী এক ধরনের অসহায়ও বটে। কারণ, বাংলাদেশে তাদের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বলা যায় না। সরকারের নির্দেশেই তাদের কাজ করতে হয়। এককথায় রাজনৈতিকভাবে যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের দিক-নির্দেশনা মানতে হয়। আবার পুলিশের পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন অনেকে, কিংবা এই কাঠামোকে যারা রাজনীতিকরণের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান, তারা এসব করে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেন। ফলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের মধ্যে সংক্ষুব্ধতা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এখানে দায়টা পুলিশ ও সরকারের। তবে, পুলিশ যদি আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সীমারেখা মেনে কাজ করতে পারত, তাহলে এই সংকট এড়ানো সম্ভব হতো বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

আইনজ্ঞরা বলছেন, রাজসাক্ষী হওয়া একজন ব্যক্তিকে বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনি সুবিধা দেওয়া হয়। আসামি থাকলেও নিজের জ্ঞানে থাকা সব তথ্য ও সত্য উন্মোচিত করলে তার মতামতকে প্রাধান্য দেন আদালত। এতে অনেক আইনি প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ থেকে কিছুটা মুক্ত থাকেন রাজসাক্ষী। আইন অনুযায়ী অ্যাপ্রুভারের দেওয়া তথ্য বা সত্য প্রকাশের ওপর সাজা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ তার জবানবন্দিতে আদালতকে সন্তুষ্ট হতে হবে। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ক্ষেত্রেও সেটি করবেন আদালত। তবে, তাকে কোনো একটি বিশেষ ব্যবস্থার সুবিধা দিতে গিয়ে পেছনের ঘটনাগুলো বা সত্য উদ্ঘাটনে যেন কালক্ষেপণ না হয়। কারণ, এখন যারা পুলিশে রয়েছেন, তাদের জন্য ভবিষ্যতে নিজেদের পেশাগত সুনাম ধরে রাখতে একটা ‘সেফগার্ড’ বা রক্ষাকবচ হিসেবে নির্দেশনা পাবেন। এছাড়া, যারা বাহিনীর সুনামকে রাজনৈতিক শক্তির কাছে বিক্রি করে দিতে চান বা করেছেন, তাদেরও শনাক্ত করা প্রয়োজন।
সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে রাজসাক্ষী হয়ে চৌধুরী মামুন যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মূল্যায়ন করবেন বলে মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গ্রহণযোগ্য রায় এলে মানুষের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচার পাশাপাশি পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের মাত্রা অনুযায়ী সঠিক সাজার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এতে যেন প্রমাণ হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সূত্র: ঢাকা পোস্ট