মুগ্ধতার মালয়েশিয়া

কাজী মনজুর করিম মিতুল
ভ্রমণ ডেস্ক
  ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২২:৩৮

ভারত আর ভুটানের পর এবার আমার গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। এর আগে একা বা অফিসের কারো সঙ্গে গিয়েছি। এবারের ভ্রমণ সপরিবারে। সেই সুযোগ অনেকটা লটারির টিকিট জেতার মতো করেই হাতে এসেছে। আমি যখনই দেশের বাইরে গিয়ে কিছু দেখে মুগ্ধ হই, তখনই মনের অজান্তে তুলনা করে ফেলি আমার দেশের সঙ্গে। মনে হয়, আমার দেশে তো এর চেয়ে ভালো কিছু আছে, অথবা আমার দেশেও তো এমন করা যেতো...।
যেমন পিনাংয়ের বাতু ফিরিংগি সৈকতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এর চেয়ে আমাদের কক্সবাজার শত গুণে ভালো। আর যখন সেখানে জলকেলি করতে করতে আমার পুত্র জেলিফিশের আক্রমণের শিকার হলো, মনে হলো, কেন যে ছাই এখানে এলাম! কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রী-কেও বিষাক্ত হুল ফোটালো বদমায়েশ জেলি ফিশ। এরপর আর জলে থাকা চলে না। লোকে ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে ‘জেলিফিশ’ বলে গালি দেয়। এবার জানলাম, ওরা মোটেই নিরীহ নয়।
কুয়ালালামপুরের সুউচ্চ সব অট্টালিকা দেখে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, আহা, কত না বাংলাদেশের শ্রমিকদের ঘাম ও শ্রমে গড়ে উঠেছে এসব স্কাইস্ক্র্যাপার! ঢাকায় কি এমন শততলা ভবন নির্মাণ হতে পারতো না? নিশ্চয়ই আমাদের ভূমিকম্প, বন্যা ও ঘুর্ণিঝড় একটা বড় বাধা, যা কুয়ালালামপুরকে আক্রান্ত করে না।
শহর বলতে আমি কেবল কুয়ালালামপুর আর পিনাং দেখেছি। লাংকাউইকে গ্রাম বা মফস্বল বলা যায়। তবে সবখানেই মুগ্ধ হয়েছি ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখে। প্রথমত, সব ড্রাইভার নিয়মমাফিক গাড়ি চালায়, কেউ কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে না। সবাই সিগনাল বাতি অনুযায়ী চলে। দ্বিতীয়ত, আমি যে এক সপ্তাহ ছিলাম, কোন মোড়ে বা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি।
২০১৬ সাল থকে তারা Smart Traffic Analytics and Recognition System (STARS) প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছে, যা রাস্তার পরিস্থিতি অনুযায়ী লাল-সবুজ বাতি জ্বালায়। দূর থেকে সিসিটিভি দিয়ে তারা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে। তাই সব কিছু চলছে ঠিকঠাক, নিরাপদ, নিরবচ্ছিন্ন। সত্যি বলছি, যে ৮ দিন ছিলাম, আমি একটা গাড়িকেও একবার হর্ন বাজাতে শুনিনি!
পিনাং এর কোনো এক রাস্তায় Grab (আমাদের দেশের Uber এর মতো) এর গাড়িতে চলতে চলতে আমি আমার পুত্রকে বলছিলাম, বড় হয়ে তুমি যদি transportation engineer হও, অবশ্যই এদের মতো drainage system তৈরি করবে। ওদের পাহাড়গুলো থেকে যেন বৃষ্টির জমে থাকা পানি হঠাৎ রাস্তায় এসে ঝামেলা না করতে পারে, সেজন্য ওরা পাহাড়ের শরীরের ভেতর বসিয়ে দিয়েছে শত শত পাইপ। সেই পাইপ বেয়ে ওপরের পানি এসে পড়ছে রাস্তার পাশের নর্দমায়। সে নর্দমাও পরিচ্ছন্ন।
লাংকাউইর ঈগল স্কোয়ার গিয়ে দেখলাম, পর্যটকদের জন্য বন্ধ, সংস্কার কাজ চলছে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল মে দিবস। তাই শ্রমিকেরা কাজ করছিল না। সে সুযোগে ভেতরে ঢুকে দ্রুত দেখে নিলাম। মালাক্কা প্রণালীর জলের ওপর নির্মিত ডেকে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমাদের কক্সবাজারে এর চেয়ে ভালো কিছু নির্মাণ সম্ভব। ওদের প্রেগন্যান্ট আইল্যান্ড বা ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড দেখে আমি কিছুটা হতাশ৷ ভ্গগুলোতে কী ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই না এর গুণকীর্তন করে! এর চেয়ে আমাদের বান্দরবান কম যায় কিসে? লাংকাউইর স্কাই ব্রিজের আদলে আমাদের সাজেকেও একটা ব্রিজ আছে। KL Eco Forest -এর ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে আমাদের রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু দিব্যি টেক্কা দিতে পারে।
তবে মিঠা পানির হ্রদ আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্রষ্টার কী অপার ক্ষমতা! সমূদ্রের ভেতর পাহাড় দিয়ে বেষ্টিত এক হ্রদ, যার পানিতে সাঁতার কাটতে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চ অনুভূত হয়।
সেখানে আমাদের বোটে এক অস্ট্রেলিয়ান প্রৌঢ় দম্পতি ছিলেন। ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে আমাদের পরিবার সম্পর্কে নিচু স্বরে প্রশ্ন করছিলেন, ‘এরা কোন দেশের?’
ভদ্রলোকের জবাব, ‘বাংলাদেশ। ভারতের গায়ে লেগে থাকা ছোট্ট এক দেশ। ওরা দারুণ ক্রিকেট খেলে...’ আড়িপেতে তাদের কথোপকথন শুনে আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠেছিল।
তবে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে এয়ারপোর্টে যে ভোগান্তি হলো, তার স্মৃতি আমি বয়ে বেড়াব আজীবন। ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার যাবতীয় কাগজপত্র চেক করেই ক্ষান্ত হননি, আমার ফোনে ব্যাংক থেকে যেসব মেসেজ আসে, সেসব দেখেও নিশ্চিত হতে চেয়েছেন আমার মাসিক আয় কেমন। ভিসার আবেদনের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের ছাড়পত্র জমা দিতে হয় জানতাম। কিন্তু এখানে আমার ও আমার স্ত্রীর ছুটির প্রমাণ আবার দেখতে চাইলো। ভেবেছিলাম মালয়েশিয়ার পুলিশ আমাদের বেশি জেরা করবে। হলো উল্টো। সেখানে আমরা নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গেলাম। মালয়েশিয়ান একটা সিম কিনে গ্র্যাবে কল দিয়ে শুরু হলো আমাদের কুয়ালালামপুর ভ্রমণ।
এর আগে ছবি বা ভিডিওতে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখে কখনো ধারণা করতে পারিনি, কী অপার বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই গল্প পরের পর্বে।

চলবে...