বিরল ও সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। কিন্তু বরাবর অবহেলিত থেকেছে ১৮ কি.মি. দীর্ঘ অপরূপ সুন্দর এই সৈকত। দেড় দশক পূর্বে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আমি যখন কুয়াকাটা যাই, ভ্রমণসঙ্গী ছিল বাকিউল, সুজন, প্রিন্স এবং রুহুল ভাই। দ্বিতীয়বার বন্ধু ফেরদৌসকে সঙ্গে করে কুয়াকাটায় সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ ছিল।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের অবস্থান পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নে। সেই সময় কুয়াকাটা যাওয়ার সবচাইতে ভালো উপায় ছিল ঢাকা থেকে পটুয়াখালী অথবা বরিশালে লঞ্চে যাওয়া। সেখান থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা। আমরা দুবারই সারারাত্রির চমৎকার লঞ্চ ভ্রমণে প্রথমে বরিশাল এবং সেখান থেকে বাসযোগে কুয়াকাটা গিয়েছি।
কুয়াকাটা নামের উৎপত্তির সন্ধান করা যেতে পারে। ধারণা করা হয়, কুয়াকাটার আদি বাসিন্দা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রাখাইন জাতিসত্তা। সাগর সৈকতে প্রবেশের পূর্বেই কেরানিপাড়ায় একটি বড় আকারের কুয়া রয়েছে। রাখাইনরা যখন প্রথম বসতি স্থাপন করে তখন সুপেয় পানির জন্য এই কুপ খনন করেছিল। এরকম আরো বেশ কয়েকটি কুপ খনন করা হয় রাখাইনদের বিভিন্ন বসতিতে। এই ‘কুয়া’ কাটা থেকেই কুয়াকাটা নামের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।
রাখাইনদের আদি নিবাস মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে। ১৭৮২ সাল থেকে রাখাইনদের উপর বার্মিজরা বিভিন্ন সময়ে চরম অত্যাচার নির্যাতন চালায়। ১৭৮৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত রাখাইনরা পটুয়াখালী, বরগুনা ও কক্সবাজার অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় কুয়াকাটাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। কুয়াকাটার প্রথম কুপ যেখানে সংরক্ষিত সেটি মূলত শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের ভেতরের কম্পাউন্ডে। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারে রয়েছে বেশ উঁচু অষ্টধাতুর তৈরি একটি বৌদ্ধমূর্তি। বর্তমানে এটি নতুন একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির ভবনের ভেতরে স্থানান্তর করা হয়েছে। কেরানি পাড়া থেকে ৭ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে মিস্ত্রিপাড়ায় সীমা বৌদ্ধবিহারে গৌতম বুদ্ধের একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। এটি ৮.৫৩ মিটার উঁচু। অষ্টধাতু নির্মিত এই বুদ্ধ মূর্তিটির ওজন ৩৭ মণ। রাখাইনদের বিশ্বাস, শত বছর পূর্বে ‘উপেনিয়া’ নামক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
কুয়াকাটার একটি দর্শনীয় স্থান ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’খ্যাত ফাতরার বন। আন্ধারমানিক নদীর মোহনা পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে ম্যানগ্রোভ বনটি গড়ে উঠেছে। হরিণ, বানর, শূকর, বন মোরগ, শিয়াল, বাঘডাস, মেছোবাঘ, ভোদর, খরগোশ, অজগর সবই আছে এই বনে। নেই শুধু বনের রাজা বাঘ। এই ‘অভিজাত’ ও ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ প্রাণীটি না থাকায় এতো সুন্দর একটি বন হয়েও এর কৌলিন্য যেন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে! আমরা ট্রলারযোগে ফাতরার চরে গিয়েছিলাম। ফাতরার চরে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করি, সত্যি সুন্দরবনের সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই বনে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদে গড়ে ওঠা এই বনে সুন্দরবনের মতোই ছোট ছোট খালও রয়েছে। রয়েছে কেওড়া, গরান ও গেওয়া বন। ফাতরারচর বরগুনা জেলাতে পড়েছে।
কুয়াকাটার আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে লাল কাঁকড়ার চর। এখানে হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ লাল কাঁকড়া দেখা যায়। হঠাৎ বালি ফুঁড়ে লালবাহিনী প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসবে। আবার মানুষের উপস্থিতিতে মুহূর্তের মধ্যে বালির ভেতর মিলিয়ে যায়। লাল কাঁকড়ার চরে যেতে হলে গঙ্গামতি হয়ে যেতে হবে ট্রলারযোগে। মোটর সাইকেলেও যাওয়া যায়।
সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একদিন চলে যাই লেম্বুর চরে। এখানে প্রিন্স ভাই বালির নিচে পুরো শরীর ঢেকে শুধু মাথা বের করে ‘লাশ’ হয়ে শুয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ! আমরা এমনভাবে ছবি তুলি যেনো একজন মানুষের মৃতদেহ ঘিরে প্রিয়জনদের আহাজারি! জীবন যাপনে তো অভিনয় করেই যাচ্ছি আমরা। এবার না হয় একজন মানুষের মৃত্যু পরবর্তী সময়ের অভিনয়ই করলাম! লেম্বুর চর থেকে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে কুয়াকাটা ফিরে আসি। ফেরার পথে সন্নিকটে বিশাল শুঁটকীপল্লী ঘুরে দেখি। এখানে প্রচুর পরিমাণে হাঙ্গর মাছের শুঁটকী রোদে শুকানো হচ্ছে দেখতে পেলাম। বাঙালিদের কাছে এই শুঁটকীর চাহিদা না থাকলেও রাখাইনদের কাছে হাঙ্গর মাছের শুঁটকী খুবই প্রিয় ও উপাদেয় একটি খাবার।
আমাদের অস্থায়ী ডেরা কুয়াকাটা গেস্ট হাউজে ফিরে এসে খাওয়া এবং বিশ্রাম পর্ব শেষে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অনেক পূর্বেই সৈকতে চলে আসি। সন্ধ্যা থেকে সৈকতে সময় কাটাই গানে আর আড্ডায়। একজন বয়োবৃদ্ধ অন্ধ বাউল ও তাঁর কিশোরী কন্যার গান আমাদের মুগ্ধ করে। একের পর এক জনপ্রিয় বাউল গান গেয়ে যাচ্ছেন তিনি। আমি বিজয় সরকারের একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি খুবই আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, এখন তো এইসব ‘পদকর্তা’র গান কেউ শুনতে চায় না, বাবা! এরপর তিনি বিজয় সরকারের কয়েকটি গান গেয়ে শোনান। বিজয় সরকারের বিচ্ছেদী গানের কথায় হাহাকার, শূন্যতা এবং একই সাথে চমৎকার গায়কী আমাদের দীর্ঘক্ষণ আবিষ্ট করে রাখে। রাত করে গেস্ট হাউজে ফিরি। আড্ডা চলে অবিরাম। একসময় ঘুমের রাজ্যে খানিকক্ষণের জন্য হারিয়ে যাই আমরা। কাল আবার উঠতে হবে সূর্যোদয়ের অনেক আগেই।
অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ি সবাই। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে সূর্যোদয় দেখার বিরল অভিজ্ঞতাও হয়ে যায় আমাদের। এরপর বহু মানুষের সাথে সকাল বেলার সৈকত ছিল কেবলই হাঁটাহাঁটি। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সবচাইতে কাছের রাখাইন পল্লী কেরানীপাড়ায় অবস্থিত। তবে গোড়া আম খোলাপাড়া রাখাইন পল্লী কুয়াকাটায় রাখাইন জাতিসত্তার সবচেয়ে বড়ো বসতি। আলীপুর বন্দর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে এই রাখাইন পল্লী। এখানে টিন ও কাঠ ব্যবহার করে মাচার উপর মন্দিরে ছোট ছোট অনেকগুলো বৌদ্ধ মূর্তি রাখা আছে। কুয়াকাটা এলে এরমধ্যে আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর ঘুরে আসা যায়। আলীপুর বন্দরের পাশে কালাচান পাড়া কুয়াকাটার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাখাইন পল্লী।
কুয়াকাটায় একটি ব্যতিক্রমী জাদুঘর আছে ‘পানি জাদুঘর’। কলাপাড়া উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে পাখিমারা বাজারে পাশে এটি অবস্থিত। মানুষকে পানি সম্পদ ব্যবহার, সমুদ্র সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করার জন্য একটি বেসরকারী সংস্থা এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে এটি এশিয়ার প্রথম ‘পানি জাদুঘর’। আমাদের অবশ্য যাওয়া হয়নি। পরবর্তী কালে কুয়াকাটা এলে সোনার চরেও যাওয়া যেতে পারে। পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলায় সোনার চরের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের বুকে এই দ্বীপটি দক্ষিণ সীমার শেষ ভূখণ্ড। এখানেও বিভিন্ন ধরনের প্রাণী বৈচিত্র্য রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখীর আগমণ ঘটে ব্যাপক সংখ্যক। নভেম্বর মাসে কুয়াকাটাতে রাশমেলা ও সৈকতজুড়ে পুজো অর্চনার বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতা বেশ উপভোগ্য।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র কুয়াকাটা এলে সহজেই দৃষ্টিগোচর হবে। অধিক সংখ্যক ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, সাগর সৈকতের ভাঙন কুয়াকাটার অস্তিত্ব হুমমির মুখে ফেলে দিয়েছে। কুয়াকাটার ‘আইকন’ নারিকেল বীথির অস্তিত্ব এখন আর নেই। কুয়াকাটার মতো অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রকে রক্ষা করা এবং সর্বোপরী স্থানীয় মানুষদের রক্ষার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেয়াটা তাই খুব জরুরী। কুয়াকাটার আশেপাশে সমুদ্র বন্দর, শিল্পাঞ্চলসহ নানা রকম কর্মযজ্ঞ চলছে ঠিকই, কিন্তু তা কতটা পরিবেশবান্ধব সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতোমধ্যে পদ্মাসেতু হওয়ার পর কুয়াকাটা কক্সবাজারের পরই দারুণ জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমার প্রথমবার কুয়াকাটা ভ্রমণে বরিশাল থেকে পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ৭টি ফেরি পারি দিতে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ভ্রমণে পড়ে ৫টি ফেরি। এখন আর ফেরি নেই। ২০২৩ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে আমি ও জীবনসঙ্গী চামেলী কুয়াকাটা ভ্রমণ করি। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয় আমাদের যাত্রা পথে। পদ্মাসেতু দিয়ে মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টায় পৌঁছে যাই কুয়াকাটা। সকাল ৮টায় আরামবাগ থেকে রওয়ানা দিয়ে দীর্ঘ পথে একের পর এক নদী আর সেতু পাড়ি দিয়ে যখন সাগরকন্যার কাছে পৌঁছাই তখন দুপুর। অথচ একসময় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যেতে ১০টি ফেরি পাড়ি দিতে হতো। ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৪টি এবং বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে পার হতে হতো ৬টি ফেরি! একের পর এক ফেরি পাড়ি দেওয়ায় সময় ও অর্থ নষ্ট হতো। যাত্রীদের কষ্টের সীমা থাকত না। উপকূলীয় মানুষগুলোর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও ছিল না। অবকাঠামোগত কারণে কৃষি এবং মাছ ধরাই ছিল প্রধান পেশা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায় এমন সমুদ্র সৈকত থাকা সত্ত্বেও যাতায়াতের ভয়ে অনেক পর্যটক এই ভ্রমণ গন্তব্যে যেতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।
সময় বদলেছে। এখন পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে ঢাকা থেকে সরাসরি সাগরকন্যা কুয়াকাটায় মাত্র ৬ থেকে ৭ ঘণ্টায় যাতায়াত করা যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল পায়রাবন্দর ঘুরে দেখার। ইতোমধ্যে পায়রা বিদুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়েছে। নদীর অগভীরতাসহ আরো নানা কারণে পায়রা বন্দর তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
সাগরকন্যা কুয়াকাটা এখন একদম কাছে অবস্থান করছে! তাই কক্সবাজারের মতো বারবার যাওয়ার মতো আরেকটি গন্তব্য হয়ে উঠেছে কুয়াকাটা। যে সাগরপাড়ের গন্তব্য থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়, সেই সাথে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে ভ্রমণ করা যায়, সেটি জনপ্রিয় হবে স্বাভাবিক কারণেই। তবে কুয়াকাটার প্রাণ-প্রকৃতি বিশেষত ভাঙন থেকে সৈকতকে রক্ষা করাটা এখন জরুরি। নদী ও সাগরের মোহনা ড্রেজিং করাটাও অত্যাবশ্যক। সেইসাথে জরুরি ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো।