যেখানে সূর্য ওঠে বরফের কোল ঘেঁষে

জাহিদুল ইসলাম
  ১০ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:২৪

ধর্মশালা শৈলশহর।  শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বলতে কিছু নেই, ঠাণ্ডা থাকবেই। শীতে রুম হিটার ছাড়া টিকে থাকার চিন্তা অকল্পনীয়। বর্ষাতেও তাই। গায়ে মোটা শীতবস্ত্র চাপিয়ে চলতে হয়। গ্রীষ্মে সকালে প্রচণ্ড গরম, রাতে ঠাণ্ডা। তবে এখনকার যে আবহাওয়া… বর্ষা শেষে শীত আসবে আসবে বলে যে ভাব তা সবচেয়ে উপভোগ্য বলে জানালেন স্থানীয় তরুণ ভিনিড সিং। ২০১৬ সালে তার সঙ্গে পরিচয় এই ধর্মশালাতে। সাত বছর পর আবার দেখা। মিলনমেলায় কোলাকুলির পর তার একটাই কথা,‘তোমার সাথে তো কোলাকুলি করা কঠিন… পেটটাকে কি বানিয়েছ!’ উত্তরে কিছু বলতে হবে বলেই বলা, ‘সাত বছর লম্বা সময় …।’ 
ভোর তখনও অন্ধকারে ডুবে আছে। পূর্বের সূর্য হাসি দেবে একটু পরেই। আগের রাতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ। রাতে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ওই আবহ বিরাজ করছে ভোর সকালেও। অন্ধকার চিড়ে আস্তে আস্তে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। দূর থেকে দেখা মিলতে থাকে ধৌলধর রেঞ্জের শুভ্র পাহাড়সারির। মেঘ সরে আকাশ পরিষ্কার হওয়ায় হিমালয়ের সেই পাহাড় এখন দৃশ্যমান। গত কিছুদিন তার দেখা মেলেনি। কিন্তু কাঁপুনি দেওয়া ঠাণ্ডা বাতাসের কাছেই বরফের পাহাড় দাঁড়িয়ে সারি বেধে। 
সাত বছর আগে ধর্মশালার পাহাড়ের নিচে থেকেছিলাম। এবার ওপরে। ওপরে মানে ম্যাকলয়েডগঞ্জে। যেখানে উঠে গোটা শহর দেখা যায়। শহরের প্রাণকেন্দ্র চউক সেখানেই মানে আমাদের মোড়। যেখানে বাতাসে ম্যাগি নুডলস আর মোমোর গন্ধ মৌ মৌ করে। দেশি বিদেশি নানা রেস্টুরেস্ট, পানশালা ও স্থানীয় বাজারের সমারোহ। ওই চউক থেকে দ্য মেইন পয়েন্টে নেমে আসতেই চোখে পড়বে এই শহরের প্রাণভোমড়া দালাইলামার মনাষ্ট্রি। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিরা স্বাধিকার আন্দোলন করলে সেটি ব্যর্থ হয়। তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। বর্তমানেও তিব্বতিরা নিজেদের চীনের অংশ হিসেবে ভাবেন না। নিজেদের ভারতীয় বলেও দাবি করেন না তারা। আলাদা রাষ্ট্র, আলাদা গণতন্ত্র গঠন করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় বিশ্বাসী তিব্বতিরা। দেশ ছেড়ে পালানোর ৬৪ বছর পরও তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন দালাইলামা। আজও তার সমর্থকরা স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভ করে। প্রতি বছরের ১০ মার্চ দিনটিকে অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালন করে তিব্বতিরা। দালাইলামা অবশ্য ম্যাকলয়েডগঞ্জ বা ধর্মশালায় থাকেন না। শহরের অদূরে বীর অ্যান্ড বিলিংয়ে তার মূল আশ্রয়স্থল। যেখানে চলে তার সাধনা, তাপস্যা। 
জীবন ধারণের জন্য এই অঞ্চলের মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। ছোটখাটো ব্যবসা। পাহাড়ের মানুষগুলো এমনিতেও কঠোর পরিশ্রমী। কাজে-কর্মে কথাবার্তায় তাদের সেই পরিশ্রমের গল্পগুলো উঠে আসে। স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে কথায় কথায় জানা গেল, সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের দিন শুরু। সূর্য ডুবলেই সব শেষ! তবে সাত বছরের আগের চিত্র আর এখনকার চিত্র অনেক তফাৎ। দিন-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত সব সময়ই শহরের প্রাণকেন্দ্র জেগে থাকে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ক্যাবল কার চালু করেছে। সাধ্যের মধ্যেই সেই কেবল কারে পুরো ধর্মশালা ঘুরে দেখা যাবে ৪৫ মিনিটে। চাইলে মেঘ ছুঁয়ে চকচকে ঝলমলে রোদের ছোঁয়াও পাওয়া যাবে। 
সমুদ্রসমতল থেকে এই ধর্মশালার উচ্চতা ১৪৫৭ মিটার। অনিন্দ্য সুন্দর শহরটাকে দেখলে মনে হবে ভিউকার্ড। এমন সুন্দর শহরে মেঘের সমুদ্র পেরিয়ে সূর্য ওঠে বরফের কোল ঘেঁষে। ভোরের কোমল রোদে অপার্থিব এই সৌন্দর্য প্রকৃতির প্রেমে বাধ্য করবে যে কাউকে।