পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ কক্সবাজারের পর্যটন

ডেস্ক  রিপোর্ট
  ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:১৩

পর্যটননগরী কক্সবাজার ঘিরে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা এখনো পরিকল্পনায়ই সীমাবদ্ধ। কক্সবাজারকে স্মার্ট নগরীতে রূপান্তরের ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ সবে শুরু হয়েছে।
সে পরিকল্পনা অনুমোদন শেষে বাস্তবায়নে আরও কত বছর লাগবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ সাশ্রয়ী গণপরিবহন রেলযাত্রায় যুক্ত হয়ে গেছে কক্সবাজার।  
আসছে ১ ডিসেম্বর রেলপথে কক্সবাজার যেতে শুরু করবেন দেশি পর্যটকরা। খুব শিগগিরই কক্সবাজার বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে খুলে দিলে সমুদ্র ছুঁয়ে বিমান নামবে পর্যটননগরীতে। বর্তমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় একসময় এভিয়েশন হাব হিসেবে পরিণত হবে কক্সবাজার এয়ারপোর্ট। রেলযাত্রা উদ্বোধনের দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন এ রেলপথ সারা দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গেও কক্সবাজার রেলপথ সংযুক্ত করা হবে। তার মানে অল্প সময়ের মধ্যেই কক্সবাজারের সঙ্গে সড়ক, রেল ও বিমান পথে স্বাচ্ছন্দ্যের ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ শুরু   হবে। প্রতিদিন আরও বিপুলসংখ্যক মানুষ পর্যটননগরী কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের বিনোদনে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ গড়ে ওঠেনি।
উল্লেখ্য, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজারের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রণীত হয় একটি মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে তা কার্যকর হয়নি। অবশেষে প্রায় আট বছর পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় শুরু হয় নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট-সিএসসির তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএসসি নিয়োগ গত ১৬ আগস্ট ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এর মাধ্যমে ‘কক্সবাজারকে স্মার্ট শহরে রূপান্তরের’ জন্য ২০২৩ থেকে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হবে, যদিও পরিকল্পনা প্রণয়নেই মেয়াদের দেড় বছর চলে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হবে মাস্টারপ্ল্যানটি; যা বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে কক্সবাজারের উন্নয়নচিত্র। তবে এ মাস্টারপ্ল্যান তৈরির পাশাপাশি শহরের অন্তর্বর্তীকালীন উন্নয়ন কাজ চলতে থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের আট উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া ও সি-বিচ এরিয়ার প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায়। এ এলাকাগুলোর রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য। একেকটি এলাকায় একেক ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কুতুবদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত প্রায় ৬৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্র। এই বিস্তৃত এলাকা পরিকল্পিত উন্নয়নের আওতায় আনতে বিপুল বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনী পরিকল্পনা দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর সম্পৃক্ত করা ছাড়া পর্যটন খাতে বড় সাফল্য নিয়ে আসা সম্ভব নয়। সরকার নীতিসহায়তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা ছাড়া সবকিছু করে দেবে তা ভাবা ঠিক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যটকরা কক্সবাজারে শুধু সি-বিচ দেখতে আসেন না। তারা এক বেলা সি-বিচ দেখে আরও বাড়তি বিনোদন ক্ষেত্র খুঁজে বেড়ান। এ ক্ষেত্রে তাদের যাওয়ার জায়গা খুবই কম। পর্যটকদের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বিনোদনের জন্য সি-বিচের বাইরেও নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। বেসরকারি খাত সম্পৃক্ত করে এমিউজমেন্ট পার্কসহ অনেক পর্যটন স্পট ডেভেলপ করা যায়। কক্সবাজারে বহুমাত্রিক পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর এখনই সময়। বাণিজ্যিক ট্রেন যখন এসে গেছে, ব্যাপকহারে পর্যটকও আসবে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কক্সবাজারে তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেই।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কক্সডিএ) সূত্র জানান, কক্সবাজারকে স্মার্ট পর্যটন নগরীতে রূপান্তরের ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা গত মাসেই কাজ শুরু করেছেন। আকর্ষণীয় ও পরিবেশবান্ধব কক্সবাজারের পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি বিশদ এলাকা পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা সংবলিত স্মার্ট শহর হিসেবে গড়ে তুলতে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক অখণ্ড সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য অক্ষত রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
কক্সডিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নূরুল আবছার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশিদের জন্য একটি বিশেষায়িত পর্যটন অঞ্চল এবং দেশের দীর্ঘতম ও একমাত্র সামুদ্রিক রানওয়েসহ একটি অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার মাধ্যমে কক্সবাজারকে পর্যটন ও বিমান চলাচলের বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করছেন। এর মধ্যে রয়েছে কৌশলগত নীতি পরিকল্পনা প্রণয়ন, কক্সবাজারের সব উপজেলা ও সৈকত এলাকার বিশদ পরিকল্পনা (৬৯০ দশমিক ৬৭ বর্গ কিলোমিটার) এবং পর্যটন ও আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১-কে সমর্থন দিতে কক্সবাজার বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার থেকে সাবরাং ও কক্সবাজার থেকে মহেশখালী পর্যন্ত ক্যাবল কার স্থাপন, সমুদ্রসৈকতে ওয়াটার স্পোর্ট ও অন্যান্য বিনোদনসুবিধা চালু, ইনডোর বিনোদন পার্ক, কক্সবাজার মেরিনা বে রিসোর্ট, মহেশখালীতে ইকো-রিসোর্ট, জীবনরক্ষা ও সামুদ্রিক পর্যটন বৃদ্ধি, ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে রোডম্যাপ প্রণয়ন, সি-প্লেন, ক্রুজ শিপ এবং হেলিকপ্টার পরিষেবা প্রবর্তন ও সমন্বিত কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত জরিপ প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকায় একটি আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটননগরী গড়ে তোলার জন্য জমির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। আগামী ৫০ বছর জমিতে যে কোনো প্রকৃতির অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ এবং অঞ্চলের সুপরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কক্সবাজার জেলার বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা (ডিএপি)সহ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় রয়েছে টেকসই পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পাহাড়, বন, জলাশয় ও সামুদ্রিক এলাকা সংরক্ষণ, সীমাবদ্ধ সমুদ্রসৈকত সংরক্ষণ, অবৈধ ও অপরিকল্পিত স্থাপনা অপসারণ, পানি, ভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। দূষণ, বর্জ্য ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা। সব ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সুবিধা নিশ্চিতকরণ, আবাসন পরিকল্পনা, সৈকতের সৌন্দর্যায়ন এবং ভূমিক্ষয় রোধে কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। ২০ বছর মেয়াদি কক্সবাজার উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজটি দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করে মাঠ পর্যায়ে কাজে নেমে পড়া দরকার। কক্সবাজার ঘিরে ভ্রমণপিপাসু মানুষের মধ্যে যে আবেগ তৈরি হয়েছে তা যেন দীর্ঘতম সৈকতের বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে না পড়ে।  
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন