সার্বিয়ার রয়েল প্যালেস থেকে যখন বের হই, সময় তখন ভর সন্ধ্যা। প্যালেসের মূল ভবন থেকে তাও ৩০০ ফুট দূরে ফটক। আমাদের গাড়িবহর সেখানেই। দু’পাশে ফুলের বাগান। মাঝে সরু রাস্তা। এ পথটুকু হেঁটে গাড়িতে উঠতে হবে। চারপাশে নিয়ন আলো। তাতে সবুজ গাছপালার রূপান্তর যেন ফিকে টিয়ে রঙে। মুষলধারে বৃষ্টি শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। বাইরে তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। আসলে কি ঝিঁ ঝিঁ পোকা? পৃথিবীর সব দেশেই কি এটা পরিচিত দৃশ্য? কী এক মাদকতায় মন উদাস হয়ে ওঠে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। এতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য আমি। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ নানান ক্ষেত্রে সার্বিয়ার অবস্থান তুলে ধরতেই ঘোরাঘুরির এই কর্মসূচি। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা– স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ।
দিনভর ঘোরাঘুরি। বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় এবার গন্তব্য সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মিটারেরও বেশি উঁচুতে এই গির্জা। ভূগোলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘মালভূমি’। দিনের বেলায় রোদ থাকলে গির্জাটিকে ঝকঝকে লাগে। স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো নান্দনিক সৌন্দর্যের এই নিদর্শন থেকে চোখ সরানোই দায়। এটি অবস্থিত ভ্রাকার পাহাড়ের চূড়ায়। এর বড় সুবিধা হলো বেলগ্রেডের যেকোনও অ্যাপ্রোচ রোড থেকেই দেখা যায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণমন্দির। এর ভেতরে ১০ হাজারেরও বেশি লোক একসঙ্গে প্রার্থনা করতে পারে।
আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে এর অবস্থান দ্বিতীয়। আয়তন তিন হাজার ৬৫০ বর্গমিটার। সাত হাজার ৯৬০ বর্গমিটার ভেতরের আয়তন নিয়ে তালিকার প্রথমে রয়েছে আয়া সোফিয়া। তুরস্কের ইস্তানবুুলে অবস্থিত এই গির্জা অবশ্য এখন মসজিদে রূপ নিয়েছে।
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
ঘন জঙ্গলের বুক চিরে যাওয়া সড়কে আমাদের গাড়ির গতি অনেকটাই ধীর। সড়কে যানচলাচল কম। শোঁ শোঁ করে ভেঁপু বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে দু’একটা গাড়ি। সড়কের পাশে কোথাও কোথাও রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। সাদা, মেটে বা লালচে রঙের একেকটা ঢাউস আকৃতির বাড়ি।
সার্বিয়ার রাজধানী শহর বেলগ্রেডকে বলা হয় ‘জাদুঘরের শহর’। এটি ‘গির্জার শহর’ নামেও পরিচিত। বিশ্বব্যাপী ঢাকার নামডাক যেমন মসজিদের শহর।
সার্বিয়ার অধিবাসীদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান। তাদের প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থোডক্স এবং ৫ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক। মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩ শতাংশ। ১ শতাংশের মতো লোক ধর্মকর্মের ধার ধারে না। সার্বিয়ার সংবিধানও ধর্মীয় বিধিনিষেধকে সমাজের প্রচলিত আইনকানুনের মধ্যে আনেনি। যার যা খুশি করা যায়, শুধু সমাজে শান্তি থাকলেই হলো। তবে সার্বিয়ানরা গির্জাকে কেন্দ্র করেই দৈনন্দিন জীবনের কাজ চালিয়ে নেয়। গোটা সার্বিয়া জুড়েই অসংখ্য গির্জা, মঠ, খ্রিস্ট-ধর্মীয় উপাসনালয়ের ছড়াছড়ি। এছাড়া আছে অসংখ্য দুর্গ। বেলগ্রেডকে তাই বলা হয় সাদা শহরের দেশ।
বেলগ্রেডের গির্জা ও মঠগুলোর নির্মাণকাল পঞ্চদশ শতকের পরে। ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের জন্য ১৯২৬ সালে একটি উপসানালয় নির্মাণ করা হয়। এর নাম ‘বেলগ্রেড সিনাগগ’। এটি বেলগ্রেডের কেন্দ্রস্থলে মার্শালা বিরজুজোভা স্ট্রিটে অবস্থিত। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় বেলগ্রেড শহরে মসজিদ ছিল ২৭৩টি। এরমধ্যে এখন টিকে আছে একটি মসজিদ– ‘বৈরাকলি’ বা ‘বজরকলি জামিজা’। এর অবস্থান শহরের জেভরেমোভা গোসপোদা সড়কে। তুর্কি আমলে ১৫৭৫ সালের দিকে গড়ে তোলা হয় এটি। বেলগ্রেডের প্রাচীনতম স্থায়ী ভবনের একটি এই মসজিদ।
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
রয়েল প্যালেস থেকে আধাঘণ্টার পথ। গাড়ি এসে থামে অর্থোডক্সের সামনে। বৃষ্টির তখনও বিরামহীন গতি। ছাতা নিয়ে হাজির সিস্টার। কেবল আমার বেলাতেই ছাতা নেই! হাতে ছিল সবার কোভিড টেস্টের রেজাল্টের ফাইল। অগত্যা সেটাই মাথায় ধরে দেই ভৌঁ দৌড়। ভয়ও করে, পা পিছলে যদি পড়ি কোট-স্যুট ভিজে একাকার হয়ে যাবে!
ফুলের তোড়া দিয়ে আমাদের বরণ করে নেন চার্চের পাদ্রীরা। সামনে মেলে ধরা হয় কয়েক রকমের মিষ্টির ডালা। কালোজামের মতো বিশাল একটা মিষ্টি তুলে মুখে পুরে নিলাম। মিষ্টি আকার এতই বড়, না পারি মুখ নাড়াতে, না পারি গিলে ফেলতে। অর্ধেক চিবানো অবস্থাতেই গিলে ফেলি। গলার ভেতর ঢুকতে চায় না, জোর করে গেলা। ফলও ছিল হাতেনাতে, পরের তিন-চার দিন গলা ব্যথা।
ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ৭১টি দেশের প্রতিনিধি। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পুরো সার্বিয়া চষে বেড়ান তারা। এর অংশ হিসেবে সকাল থেকে প্রতি ঘণ্টায় এই গির্জায় একেক করে প্রতিনিধি দলের আনাগোনা। মূল দেবীর সামনে আমাদের আসন। একজন পাদ্রী আমাদের ব্রিফ করেন, ‘গির্জাটির নামকরণ সেন্ট সাভার নামে; যিনি সার্বিয়ার একজন রাজপুত্র ছিলেন। সংসার-টংসারের জাগতিক বিষয়ে তার কোনও আগ্রহ ছিল না। ধ্যানচর্চাই ছিল তার ব্রত, বেছে নেন সন্ন্যাসীর জীবন। তবে পড়াশোনা ছাড়েননি। আইন ও কূটনীতি বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। বেশিদিন অবশ্য বাঁচেননি তিনি, ১১৭৪ সালে জন্মের পর মারা যান ১২৩৬ সালে। ধর্মগুরু হিসেবে অনুসারীদের শ্রদ্ধাভক্তির আসনে ছিলেন সেন্ট সাভা। তবে ১৫৯৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর অটোমান সৈন্যরা সেন্ট সাভার সমাধিসৌধ পুড়িয়ে দেয়।’
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল চার্চ
পাদ্রী ইংরেজিতে কথা বলেন। যদিও ক্যাথলিক চার্চ ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে লাতিন ভাষাকে গুরুত্ব দেয়। আর অর্থোডক্স চার্চ নিজেদের ভাষাই ব্যবহার করে। ধর্মীয় দিক থেকেও দুটোর সমান মর্যাদা। সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে বিশ্বাসীরা সেন্ট সাভা অর্থোডক্স ক্যাথেড্রালকে তীর্থভূমি মনে করেন, যেমনটা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কাছে ভ্যাটিকান পবিত্র তীর্থভূমি।
আহা ধর্ম, প্রতিটি ধর্মের মূলকথা– স্রষ্টার সন্তুষ্টি মেনে শান্তিময় সমাজ। অথচ এক ধর্মের লোকজন আরেক ধর্মের অনুসারীদের পাত্তাই দিতে চান না। ঝামেলাটা বাঁধে তখনই। পাদ্