বাল্টিক সাগরকন্যা পিয়েতারসারি

রোমেনা লেইস
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৩২

নদীমাতৃক বাংলাদেশ আমার দেশ। আমার জন্ম বাংলাদেশ নামক বদ্বীপ এ। হয়তো এজন্য দ্বীপ আর নদী আমাকে টানে।সুনামগঞ্জে জন্ম আর তাই পাহাড়ের নীল আমাকে আকুল করে।দিগন্তে টানা নীল পাহাড়ের সারি কিংবা সারি সারি পাহাড় আমাকে মোহাবিষ্ট করে।অরোরা দেখার স্বাধ আমার অনেক দিনের।নীশিথ সূর্যের দেশ দেখতে যাবো একদিন স্বপ্ন ছিলো মনের কোণে।মেয়ে আমার এবছর তাই আমাকে দেখাতে চায় আমার আরাধ্য দেশ। সেজন্য পরিকল্পনা হলো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো দেখতে যাবো। ২০১৯ এ আমাদের আসলে যাবার কথা ছিলো ফিনল্যাণ্ড ।করোনার প্রকোপ বাড়লে সব অদলবদল হয়ে যায়।
এবছর ব্রিটিশ এয়ারলাইনস এ টিকিট বুকিং দিয়েছে আমার মেয়ে মার্চ মাসে। তারপর থেকে সব প্ন্যানিং চলছে । আমার মামাতো ভাই বাবু ইমরান সেই ১৯৮৫ সালে ফিনল্যাণ্ড চলে যায় পড়তে । ইঞ্জিনীয়ারিং কমপ্লিট করে ওখানেই সেটেল করে।বিয়ে করে ফিনিশ মেয়ে তানিয়াকে।ওদের তিনছেলে। এখন থাকে পিয়েতারসারি বা জ্যাকবস্টাডএ।সবাইকে নিয়ে ২০১২ তে এসেছিলো নিউইয়র্কে। তখনই দেখা হয়েছিলো । এবছর ওর বড় ছেলে ডেনমার্কে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ।মেজো ছেলে হেলসিংকি ইউনিভার্সিটিতে।আমাদের দুই সপ্তাহের প্ল্যান করা হলো। বাবু ব্রাসেলস থেকে বেডমিন্টন টুর্নামেন্টে খেলে ফিরবে সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ । আমরা চার তারিখ হেলসিংকি এয়ারপোর্টে পৌঁছে ট্রেনে ওর বাসায় যাবো।তিনদিন আমরা পিয়েতারসারি শহর ঘুরবো, ওদের বেডমিন্টন টুর্নামেন্টে উপস্থিত থেকে খেলা দেখবো।
৪ সেপ্টেম্বর । আমরা জেএফকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ফিনএয়ার এ যাত্রা করলাম ইউএসএর টাইম রাত দশটায়।ফিনএয়ার, বৃটিশ এয়ারলাইনস আর আমেরিকান এয়ারলাইনস কম্বাইন্ড করে ফিনএয়ার এর ম্যানেজমেন্ট এ চলে।সাত ঘন্টা পর ফিনল্যান্ডের হেলসিংকির ৪ তারিখ সকাল। এখন পরিস্কার ঝকমক করা আকাশ । নীল যেন স্ফটিকতুল্য ।তুলতুলে সাদা সাদা মেঘের কারুকাজ।মনে হয় যেন সাদা পরীরা নীল কার্পেটের উপর ব্যালে ড্যান্স করছে।উপরের মেঘ পার হয়ে ফিনএয়ার এর এয়ারবাস চমৎকার স্মুথভাবে ল্যান্ডিং করলো ।আমরা এয়ারপোর্টের আনুষঙ্গিক কাজ সেরে লাগেজ বেল্টে আসলাম ।
আমাদের লাগেজ তখনিই আসলো। বের হয়ে উল্টো পাশে ট্রেন স্টেশনে এসে টিকেট কেটে ট্রেনে উঠার জন্য অপেক্ষায় আছি । গন্তব্য সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন।তিন মিনিট পর ট্রেন আসলো।আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম । পাঁচটা স্টপ পরে শেষ স্টপ আমাদের গন্তব্য । বেশ বড় স্টেশন।ইন্টারসিটি ট্রেন এখান থেকেই ছাড়বে কয়েক ঘন্টা পর । আমাদের ট্রেন আছে পিয়েতারসারী বা জ্যাকবস্টাড যাবার । যার টিকিট আগেই কেটে রাখা। আমরা একটা কফিশপে চিকেন স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে বসলাম ।কাচের জানালা দিয়ে ট্রেন একপাশে আর আরেক পাশে বাস গুলো দেখা যাচ্ছে । আমাদের চোখ জাফীরের প্রত্যাশায় ।আমার ভাই বাবুর মেজোছেলে জাফীর ও হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ।
 কিছু ক্ষণ পর আমাদের সাথে দেখা করতে আসলো ।বারো বছর পর দেখা হলো। ২০১২ তে  নিউইয়র্ক এ দেখা হয়েছিলো । আট বছরের বাচ্চা ছিলো তখন । আমি ইংলিশ এ হাও আর ইউ বললে ও পরিস্কার বাংলায় জানতে চাইলো আমরা কেমন আছি? ওর বাংলা শুনে গর্ব অনুভব করি।আমরা হেলসিংকির রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। হেলসিংকি নিউইয়র্কের মতো মাল্টিকালচারাল মনে হলো। সুইডিশ, এরাবিক, ফিনিশ আফ্রিকান ,এশিয়ান সব ধরনের মানুষ দেখলাম । আমাদের দেশের মনিপুরি মেয়েদের পোশাকের মত পোশাক পরা কিছু মেয়ে দেখলাম জাফীর জানালো এটা ফিনিশ ঐতিহ্যবাহী পোশাক। এরা ট্রেডিশনাল পোশাক পরে সবসময় ।
চারঘন্টার ট্রেন জার্নির পর আমরা রাতে ছোট শহর পিয়েতারলসারিতে এসে পৌঁছালাম।বাবু স্টেশনে এসেছিলো । আমার স্মৃতি আমাকে গভীর রাতে নীলফামারী পৌঁছানোর দিনগুলোতে নিয়ে গেলো।বুকের ভেতরে স্মৃতির জোনাকীরা উড়াউড়ি করছে ।মা,মামারবাড়ি,মামা,মামী ,নানী,ভাই বোন সব যেন সেলুলয়েড এর ফিতেয় ছুটে ছুটে এলো।
বাবুর গাড়ি করে মাত্র কয়েক মিনিট ড্রাইভ করে আমরা ওর সাদা রঙের চমৎকার বাড়িতে এসে পৌঁছালাম রাত প্রায় দশটার দিকে।কতদিন পর দেখা । তানিয়া আর সুজন অপেক্ষায় ছিলো ।একসাথে গল্প করতে করতে রাতের খাবার খেলাম ।তারপর চা নিয়ে বসে চললো গল্প। সুজন সকালে স্কুলে যাবে বাবুরও অফিস ।তাই আর দেরি না করে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
ফিনল্যান্ড টানা কয়েকবছর ধরে সুখী মানুষের দেশের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে।যে রাষ্ট্রের জনগণের জীবনমান যত ভালো, সে রাষ্ট্র তত সুখী। ফিনল্যান্ড ফিনদেরকে অনেক আগে থেকেই জীবনের সকল ক্ষেত্রে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনসংশ্লিষ্ট সকল অধিকারের সুরক্ষার নিশ্চয়তা তো আছেই, আছে জবাবদিহিমূলক আইন ব্যবস্থা।এখানে কোর্টে মামলা অমীমাংসিত ঝুলে থাকে না। ফলে অপরাধের হার অনেক কম। সামাজিক আর পারিবেশগত শান্তি বিরাজ করলে একটা দেশের মানুষের মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকে।যদিও সকল ফিনিশ রা এর সাথে একমত নয়।
ফিনিশ জাতীয় কবি জোহান লুডভিগ রুনবার্গের বাড়ি, জ্যাকবস্টাড বা পিয়েতারসারি । ফিনিশরা যেহেতু পিয়েতারসারিই বলে আমিও বলবো ।সুইডিশরা বলে জ্যাকবস্টাড । পিয়েতারসারি হল একটি দ্বিভাষিক পৌরসভা যেখানে ফিনিশ এবং সুইডিশ এর সরকারী ভাষা। জনসংখ্যার ৩১ % ফিনিশ ভাষাভাষী, ৫৪ % সুইডিশ ভাষাভাষী এবং অন্যান্য ভাষার ১৫% ভাষাভাষী।
সমুদ্রের ধারে অবস্থিত শহরটি। উপকূলবর্তী একটি শহর হিসাবে, পিয়েতারসারিতে জাহাজ নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হয়ে ওঠে। ১৮ শতকে পিয়েতারসারি ফিনল্যান্ডে নতুন জাহাজের বৃহত্তম উৎপাদক হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ সালে নৌচলাচল অধিকার ,সরাসরি বিদেশী বন্দরে যাত্রা করার অধিকার মঞ্জুর করা পিয়েতারসারি সহ বোথনিয়ার উপকূলে অনেক শহরের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। নতুন অধিকার ফিনিশ শিপিং শিল্পের জন্য নতুন ট্রেডিং রুট খুলেছে। ১৭৮২ সালে, ফ্রিগেট কনকর্ডিয়া ছিল ইস্ট ইন্ডিজে যাত্রা করা প্রথম ফিনিশ জাহাজ। পিয়েতারসারিতে নির্মিত বার্ক হারকিউলিস ১৮৪৪ এবং ১৮৪৭ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পাল তোলা প্রথম ফিনিশ জাহাজ হয়ে ওঠে।
অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পের মধ্যে রয়েছে করাতকল থেকে আলকাতরা, পিচ এবং পণ্য রপ্তানি, যা পিয়েতারসারিকে একটি ধনী শহরে পরিণত করতে অবদান রাখে। ১৯ শতকের শেষের দিকে শহরটি শিল্পোন্নত হয়ে ওঠে।১৮৮৩ সালে একটি চিকোরি কারখানার মাধ্যমে শুরু হয়। ২০ শতকে পাল্প এবং প্লাস্টিক শিল্প পিয়েতারসারি কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে পিয়েতারসারির কাঠ, সজ্জা, জাহাজ নির্মাণ এবং খাদ্য পণ্যের একটি সমৃদ্ধ শিল্প রয়েছে। স্ট্রেংবার্গ তামাক কারখানা পিয়েতারসারির বৃহত্তম নিয়োগকর্তা ছিল। পিয়েতারসারি এর উপকূল বরাবর সৈকত এবং পোতাশ্রয় সহ দেখার জন্য একটি সুন্দর দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এটি তার পার্ক এবং উদ্যানগুলির জন্যও পরিচিত, যেমন রোজেনলুন্ডের ভিকার অ্যাসপেগ্রেনের বাগান এবং স্কোলপার্কেন বোটানিক্যাল গার্ডেন ১৯১৫-১৯৩২ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। বাগানে হাজার হাজার বিভিন্ন ধরণের গাছপালা রয়েছে। পিয়েতারসারি সিটি হল একটি ঐতিহাসিক ভবন।পিয়েতারসারির আয়তন ৮৮.৫২ কিমি বা ৩৪.১৮ বর্গ মাইল। পানি আর ভূমি মিলে ৩৯৬.৩৫ কিমি। পিয়েতারসারির জনসংখ্যা আনুমানিক ১৯০০০।এটি ফিনল্যান্ডের ৬০ তম জনবহুল পৌরসভা। ভাসা শহরটি পিয়েতারসারি থেকে ৯৮ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
শহরের ফুটবল দল এফএফ জারো বর্তমানে ফিনল্যান্ডের দ্বিতীয় লীগে খেলে। নারী লীগ ফুটবল ক্লাব এফসি ইউনাইটেড বছরের পর বছর ধরে বেশ সফল।বাবু ইমরান ও তানিয়া ইমরান পিয়েতারসারিতে একটি পিয়েতারসারি টেনিস সেন্টার নামে সেন্টার পরিচালনা করে।বাবু নিজে বেডমিন্টন খেলে এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ।তার দুই ছেলেও দক্ষ বেডমিন্টন খেলোয়াড় । ছোট ছেলেও বেডমিন্টনে দক্ষ হয়ে উঠছে।তারা ইতিমধ্যে ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেছে ।
পিয়েতারসারিতে বেশ কিছু বাংলাদেশী আছেন ।রেস্টুরেন্ট আছে বাংলাদেশীদের পরিচালিত ।বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া বা ভ্রমণ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাই পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কখনো যদি ভ্রমণের সুযোগ আসে, আমি সেটা হাতছাড়া করি না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবীব্যাপী চলা ৮৫ বছরের এক গবেষণার ফলাফল বলছে, খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়ামের চেয়েও পরিবার আর বন্ধু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।