ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরতেই বিভীষিকাময় হয়ে ইঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের জীবন। অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড় ও বিতাড়নের পর এবার আইনি পথে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা লাখো মানুষকেও অনিশ্চয়তায় ফেলছে নতুন নতুন নীতি। প্রশাসনের কড়াকড়ি, আবেদন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, নতুন ফি নির্ধারণ ও নিরাপত্তা সংস্থার অতিরিক্ত ক্ষমতা—সব মিলিয়ে বৈধ অভিবাসীদের জীবনেও নেমে এসেছে এক অচেনা ভয়ের ছায়া।
নিউইয়র্কভিত্তিক অভিবাসন আইনজীবী কিম জেভিয়ার প্রতিদিনই ক্লায়েন্টদের ফোনে শুনছেন উৎকণ্ঠার গল্প। কেউ ভিসা নবায়নের অপেক্ষায় আছেন মাসের পর মাস, কারও আবেদন হঠাৎ স্থগিত, আবার কেউ নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না প্রশাসনিক জটিলতায়।
জেভিয়ার বলেন, প্রতিদিন মনে হয় আমি যেন পানির ওপর ভেসে থাকার চেষ্টা করছি। প্রতি শুক্রবার এলেই মনে হয়—এবার আবার কী নতুন নিয়ম আসছে?
সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে, এইচ-১বি ভিসা আবেদন ফি বাড়িয়ে ১ লাখ ডলার করা হবে। প্রযুক্তি ও শিক্ষাখাতে বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য এই ভিসা দীর্ঘদিন ধরে প্রধান সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু নতুন ফি কাঠামো কার্যত বহু যোগ্য আবেদনকারীর নাগালের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে প্রশাসন আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। যার ফলে বৈধভাবে আবেদনকারীরাও পড়ছেন অনিশ্চয়তায়।
জেভিয়ার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইনি অস্পষ্টতায় জর্জরিত। তিন দশক আগেও কেউ সহজেই আবেদন করে কয়েক মাসে গ্রিন কার্ড পেতেন। এখন একই প্রক্রিয়া চলতে পারে বছরের পর বছর। মানুষ জানেই না, কখন বা আদৌ উত্তর আসবে কি না।
এমন বিলম্ব শুধু মানসিক চাপই বাড়ায় না, অনেকের কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনও বিপর্যস্ত করে দেয়। এক নারী আবেদনকারী সম্প্রতি জেভিয়ারের কাছে এসেছিলেন, তার বাবার হার্ট সার্জারি চলছিল দেশে। তিনি জরুরি ভ্রমণের অনুমতির আবেদন করেন। কিন্তু প্রশাসন সেটি প্রত্যাখ্যান করে। ফলে বাবার পাশে থাকার সুযোগও পাননি।
জেভিয়ার বলেন,আমার ক্লায়েন্ট কাঁদছিলেন। তিনি সব নিয়ম মেনে আবেদন করেছিলেন, তবুও একটা ‘না’ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁকে আটকে দিল।
অভিবাসন প্রক্রিয়ার অন্যতম বড় সংকট হলো সমন্বয়ের অভাব। একদিকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র নাগরিকত্ব ও অভিবাসন দপ্তর (ইউএসসিআইএস) অন্যদিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে আবেদনকারীর নিজ দেশের কনস্যুলেট। দুটি দপ্তরের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান ও নথিপত্র যাচাইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় অসংগতি। এতে আবেদন আটকে যায়, অনেক সময় আবেদনকারীর বৈধ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। যা তাকে গ্রেপ্তার বা আদালতের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে।
মানবাধিকার সংস্থা ও অভিবাসন আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরণের প্রশাসনিক কড়াকড়ি আসলে ‘আইনি অভিবাসন হ্রাসের এক নীরব কৌশল’। ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি ইউএসসিআইএস কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দিয়েছে। যা আগে কখনও দেওয়া হয়নি। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) এই সিদ্ধান্তকে “অভিবাসীদের ওপর নতুন দমননীতি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব পদক্ষেপ দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অংশ। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী সচিব ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিন এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা প্রতিদিন অবৈধ অপরাধীদের দেশ থেকে সরিয়ে দিচ্ছি, এবং যারা এখানে অবৈধভাবে আছে তাদের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছি—নিজে চলে যাও, না হলে গ্রেপ্তার হবেই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রশাসনের এসব কঠোরতা এখন বৈধ অভিবাসীদের দিকেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এমনকি গ্রিন কার্ডধারীরাও এখন পুরোনো ক্ষুদ্র ভুলের কারণে আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) হেফাজতে যাচ্ছেন। সম্প্রতি মিসৌরির এক আইরিশ গ্রিন কার্ডধারী নারীকে ২০১৫ সালে মাত্র ২৫ ডলারের চেক বাউন্স করার ঘটনায় আটক করা হয়।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অনেক অভিবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ দেশে ফেরার কথা ভাবছেন। আবার কেউ চুপচাপ সময় পার করছেন, আশা করছেন প্রশাসনিক এই অনিশ্চয়তা হয়তো একসময় কেটে যাবে। কিন্তু বাস্তবে জেভিয়ারদের মতো আইনজীবীরা প্রতিদিনই আরও নতুন ধরনের জটিলতা সামলাচ্ছেন।
তার মতে, এই পরিবর্তনগুলোকে ছোট মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো একসাথে এসে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে। এগুলো প্রশাসনের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। একটা করে নিয়ম, একটা করে ফি, একটা করে সীমাবদ্ধতা। সব মিলিয়ে পুরো সিস্টেমটাই হয়ে উঠছে ভীতিকর।
অভিবাসন বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই নীতিগুলো কেবল অভিবাসীদের নয়, বরং মার্কিন অর্থনীতির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে স্থাপত্য, ডিজাইন, গবেষণা, এমনকি ফ্যাশন—সব ক্ষেত্রেই বিদেশি দক্ষ কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁদের ওপর এমন চাপ পড়লে অনেক কোম্পানি বিকল্প হিসেবে কানাডা বা ইউরোপের দিকে ঝুঁকতে পারে।
প্রবাসী কমিউনিটির মধ্যে উদ্বেগ এখন স্পষ্ট। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে সম্প্রতি এক প্রতিবাদ সমাবেশে প্ল্যাকার্ড হাতে মানুষ লিখেছিলেন—‘অভিবাসীদের হাত ধরে আমেরিকার জন্ম!’ অর্থাৎ, এই দেশ গড়ে উঠেছে অভিবাসীদের পরিশ্রমে। এখন সেই অভিবাসীরাই যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
কিম জেভিয়ার বলেন, আমরা সবাই জানি, অবৈধ অভিবাসীদের ভয় সব সময় ছিল। কিন্তু এখন সেই ভয় পুরো সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি যারা সব নিয়ম মেনে এখানে আছেন তারাও ভাবছেন—পরের দিন হঠাৎ কী হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে প্রতিদিনই নতুন সংযোজন হচ্ছে। কখনো আবেদন ফি বাড়ানো, কখনো ভিসা নবায়নের শর্ত কড়াকড়ি করা, আবার কখনো দপ্তরগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো। ফলে বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
জেভিয়ার শেষ পর্যন্ত একটি স্প্যানিশ প্রবাদ উল্লেখ করলেন—‘লা গোটা কে দেরামো এল বাসো’(শেষ ফোঁটাটাই গ্লাস উপচে দেয়)। তার ভাষায়, এখন ঠিক সেই অবস্থায় আমরা আছি। বছরের পর বছর ধরে একের পর এক পরিবর্তনের ফোঁটা জমে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এখন তা উপচে পড়ছে সবার জীবনে।
বৈধ অভিবাসীদের জীবনে এই অস্থিরতা কেবল তাদের ব্যক্তিগত নয়। এর প্রভাব পড়ছে পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজজুড়েও। যুক্তরাষ্ট্রে আইনি অভিবাসন সব সময়ই ছিল দেশটির উদারতা ও বৈচিত্র্যের প্রতীক। কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থার মধ্যেই ভয়, অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাসের ছায়া ঘনিয়ে আসছে।