
মোট মার্কিন নোবেলজয়ীদের প্রায় ৩০–৪০ শতাংশই হলেন বিদেশে জন্মগ্রহণকারী, যারা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে এসে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন বা সেখানেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্বে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র যে শক্তিশালী অবস্থানটি দখল করে রেখেছে, এর পেছনে নীরবভাবে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন অভিবাসী বিজ্ঞানীরা। শুধু অর্থনীতি, রাজনীতি বা শিল্প নয়, বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল জয়েও যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সাফল্যের পেছনে এই অভিবাসী প্রতিভাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯০১ সালে নোবেলের যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বা মার্কিন নাগরিক এমন প্রায় চার শতাধিক মানুষ নোবেল পেয়েছেন। এটি বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বড় অর্জন। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে যুক্তরাষ্ট্র একাই মোট বৈজ্ঞানিক নোবেলের একটি বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। আর এই সাফল্যের একটি বড় অংশ এসেছে অভিবাসী বিজ্ঞানীদের হাত ধরে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মোট মার্কিন নোবেলজয়ীদের প্রায় ৩০–৪০ শতাংশই হলেন বিদেশে জন্মগ্রহণকারী, যারা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে এসে নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন বা সেখানেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত এই বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
বিশেষ করে ২০ শতকে নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা পরিকাঠামো আমূল বদলে দেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং কেমিস্ট্রিতে তাদের অবদান পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যের ভিত তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলের ইতিহাস অভিবাসী প্রতিভায় পূর্ণ। তাদের কয়েকজন কেবল বিজ্ঞান নয়, পুরো সভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবারে জন্ম নেয়া ওমর ইয়াঘি চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে রসায়নে নোবেল পেয়েছেন। জর্ডানের এক দরিদ্র শরণার্থী পরিবেশে বড় হওয়া ইয়াঘির শৈশব কেটেছে বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির সুবিধা ছাড়াই। বাবার পরামর্শে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে আসেন তিনি। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে-এর অধ্যাপক হিসেবে কাজ করা এই অভিবাসী বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনি মূলত মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস নামের অণুঘটক ও ছিদ্রযুক্ত অণুকাঠামো উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পান। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) তিনি নোবেল পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। তার গল্প আজ বৈশ্বিক বিজ্ঞান জগতে এক অনন্য উদাহরণ- কীভাবে এক শরণার্থী শিশুর চোখে দেখা স্বপ্ন বৈশ্বিক সভ্যতার কাজে লাগতে পারে।
আলবার্ট আইনস্টাইন জার্মানিতে জন্ম নেয়া এই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ১৯২১ সালে নোবেল পান ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যার জন্য। নাৎসি জার্মানির উত্থানের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চালান। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দেয়ায় তার নাম অমর হয়ে থাকবে।
এনরিকো ফার্মি ছিলেন ইতালিতে জন্ম নেয়া এক কিংবদন্তি পদার্থবিদ। ১৯৩৮ সালে তিনি নোবেল পান। পরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে ম্যানহ্যাটান প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং পরমাণু যুগের সূচনায় প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন।
জাপানে জন্ম নেয়া লিও এসাকি নামের এই বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে ১৯৭৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। তার টানেলিং প্রযুক্তি আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর।
নরওয়েতে জন্ম নেয়া গবেষক আইভার গিয়াভার যুক্তরাষ্ট্রে এসে ১৯৭৩ সালে নোবেল পান। সুপারকন্ডাক্টিভিটি নিয়ে তার কাজ আধুনিক ইলেকট্রনিক্সকে নতুন গতি দেয়।
এই বৈজ্ঞানিক শক্তির প্রভাব কেবল গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে। নোবেল পাওয়ার মতো মৌলিক গবেষণাগুলোই পরে জন্ম দিয়েছে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প, বায়োটেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিশাল খাত। সিলিকন ভ্যালির বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পেছনেও আছে অভিবাসী বা অভিবাসী-বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তাদের হাত।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪-১৫ শতাংশই অভিবাসী হিসেবে জন্মগ্রহণ করা মানুষ। অর্থাৎ প্রতি সাত মার্কিন নাগরিকের মধ্যে একজন বিদেশে জন্মেছেন। এই জনসংখ্যাগত বাস্তবতাই যুক্তরাষ্ট্রকে সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক করে তুলেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের জীবন বড় ধরনের স্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির নামে সীমান্ত আরও কঠোর করা হয়, আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে, এবং বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থাও হয়ে ওঠে জটিল ও ভয়ানক ধীরগতির। অনেক পরিবার এক সকালে ঘুম ভেঙে জানতে পারে-তাদের আশ্রয় নেয়া স্বপ্নের দেশে থাকা প্রায় অনিশ্চিত।
বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বহু অভিবাসী পরিবার নিয়মিত ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে দিন কাটায়। দেশটির অভিবাসীবিষয়ক ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-এর অভিযানের আতঙ্কে মানুষ সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছে, হাসপাতালে যেতে দ্বিধা করছে, এমনকি পুলিশের সামনে গেলে অনেকের বুকে কাঁপুনি শুরু হয়- কারণ যেকোনো মুহূর্তে আটক, শেকল পরিয়ে বহিষ্কার, ভিসা বাতিলের আশঙ্কা এখন চূড়ান্ত বাস্তবতা।
শরণার্থী কোটা কমিয়ে দেয়া হয়, মুসলিমপ্রধান কিছু দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা চাপানো এবং গ্রিন কার্ড ও নাগরিকত্ব পাওয়া আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্রেও অনেকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, কারণ নতুন নীতিমালায় নিয়োগপ্রক্রিয়া হয়ে উঠেছিল সন্দেহপ্রবণ ও কঠোর। এই সময়টা লাখ লাখ অভিবাসীর জন্য শুধু রাজনৈতিক প্রতিকূলতা নয় হয়ে উঠেছে এক ধরনের নীরব মানসিক যুদ্ধ- যেখানে নিজের অস্তিত্বই হয়ে উঠেছে প্রশ্নের মুখে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অভিবাসন নীতি কঠোরকরণ, ভিসা জটিলতা এবং বিদেশি গবেষকদের ওপর অযৌক্তিক বিধিনিষেধ নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই ধারা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিতে পারে। কারণ ইতিহাস দেখিয়েছে, বিজ্ঞান কোনো এক দেশের একক সম্পদ নয়- এটি সীমান্ত মানে না। যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক শ্রেষ্ঠত্ব আসলে কোনো এক জাতি বা জনমিতির একক কৃতিত্ব নয়। এটি শত শত অভিবাসী মনের মিলিত অবদান। নোবেল পুরস্কারের তালিকা শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম নয়, বরং এটি বাধাহীন অভিবাসন, মুক্ত চিন্তা এবং অবাধ সংস্কৃতির দেশের একটি নীরব দলিল।