বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে চার শুল্ক স্টেশনে বাণিজ্য বন্ধ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫

সীমান্তের ওপারে বিক্ষোভের জের ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চারটি শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে দেশের প্রধান স্থলবন্দরগুলো দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখায় স্থলবন্দরগুলোর ইমিগ্রেশন দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া শুল্ক স্টেশনগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজারের চাতলাপুর ও বটুলি এবং সিলেটের জকিগঞ্জ ও শেওলা। গত ২৭ নভেম্বর থেকে চাতলাপুর ও ২৮ নভেম্বর বটুলি স্থল শুল্ক স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। গত সোমবার থেকে বন্ধ আছে জকিগঞ্জ ও শেওলার কার্যক্রম।
এদিকে ৫ আগস্টের পর স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে দেশে পণ্য আমদানি কমেছে। তবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। দেশের নয়টি স্থলবন্দরের চলতি বছরের শেষ চার মাসের (আগস্ট থেকে নভেম্বর) সঙ্গে গত বছরের একই সময়ের তথ্য তুলনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
দেশের অন্যতম নয়টি স্থলবন্দরের কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের চার মাসে ৯টি স্থলবন্দর দিয়ে ৭৭ কোটি ৪৩ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ বছর সেটি কমে ৫৯ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে।

ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশে ঘোষিত ২২টি স্থলবন্দর আছে। যার ১৬টি কার্যকর। এর মধ্যে বর্তমানে ১১টি স্থলবন্দরের কার্যক্রম চলমান আছে। বাকি ৫টিতে বিভিন্ন সময় ধরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ আছে। এগুলোর কোনোটিতে শুধু আমদানি আবার কোনোটিতে শুধু রপ্তানি কার্যক্রম চলত। এর বাইরে প্রায় অর্ধশত শুল্ক স্টেশন রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমেও দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলে।
দেশের অন্যতম নয়টি স্থলবন্দরের কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের চার মাসে ৯টি স্থলবন্দর দিয়ে ৭৭ কোটি ৪৩ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ বছর সেটি কমে ৫৯ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৭৬ কোটি ৬৭ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছর রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ৯৩ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন।
নয়টি স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন দিয়ে চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৯২ হাজার ১১৭ জন যাতায়াত করেছেন। গত বছর একই সময়ে দুই দেশে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ৯১৫। এই স্থলবন্দরগুলো হচ্ছে আখাউড়া, বাংলাবান্ধা, হিলি, বুড়িমারী, দর্শনা, বিলোনিয়া, নাকুগাঁও, বেনাপোল ও ভোমরা।
বন্ধ হয়ে যাওয়া শুল্ক স্টেশনগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজারের চাতলাপুর ও বটুলি এবং সিলেটের জকিগঞ্জ ও শেওলা। গত ২৭ নভেম্বর থেকে চাতলাপুর ও ২৮ নভেম্বর বটুলি স্থল শুল্ক স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। গত সোমবার থেকে বন্ধ আছে জকিগঞ্জ ও শেওলার কার্যক্রম।
বিক্ষোভে অচল চার শুল্ক স্টেশন
মৌলভীবাজারের চাতলাপুর ও বটুলি শুল্ক স্টেশন দুটির বিপরীত পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। বন্দরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৭ নভেম্বর থেকে ত্রিপুরার কৈলাসহরে স্থানীয় হিন্দু সংগঠনগুলোর আন্দোলন চলছে। তারাই সেদিন ভারতের দিকে চাতলাপুর শুল্ক স্টেশনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। অপরদিকে ২৮ নভেম্বর জুড়ী উপজেলার বটুলি শুল্ক স্টেশনের বিপরীতে ভারতীয় অংশ থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে কিছু লোক এসে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
শিলচরের দুজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের আসামের শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) সীমান্তে ‘সনাতনী ঐক্য মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠনের বাধার মুখে গত সোমবার দুপুরের পর থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে শেওলা শুল্ক স্টেশনের ওপারে ভারতের সুতারকান্দিতে গত রোববার একদল বিক্ষোভকারী ‘বাংলাদেশ চলো’ কর্মসূচি দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালান। তবে সেখানকার পুলিশ ও বিএসএফের বাধায় তাঁরা ফিরে যান। তবে ওই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা। এরপর সোমবার থেকে কোনো পণ্য শুল্ক স্টেশন দিয়ে আসেনি।
মৌলভীবাজারের চাতলাপুর ও বটুলি শুল্ক স্টেশন দুটির বিপরীত পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। বন্দরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৭ নভেম্বর থেকে ত্রিপুরার কৈলাসহরে স্থানীয় হিন্দু সংগঠনগুলোর আন্দোলন চলছে। তারাই সেদিন ভারতের দিকে চাতলাপুর শুল্ক স্টেশনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জকিগঞ্জ দিয়ে কেবল পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। তবে কোনো পণ্য রপ্তানি হয় না। তবে বিয়ানীবাজারের শেওলা, বটুলি ও চাতলাপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি দুটিই হয়।
বটুলি শুল্ক স্টেশনের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পীযূষ বিশ্বাস বলেন, ভারতের ‘অখণ্ড রাষ্ট্রীয় হিন্দু সেনা’ সংগঠনের পক্ষ থেকে সেখানকার শুল্ক স্টেশনের কর্মকর্তাদের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মুক্তি দেওয়া না হলে তাঁরা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু হতে দেবে না।
আমদানি কমছে, রপ্তানি বেড়েছে
দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে গত বছরের চেয়ে এ বছর পণ্য আমদানি কিছুটা কমেছে। যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫৮ কোটি ৮৮ লাখ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। গত বছর একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৭ কোটি ১৮ লাখ মেট্রিক টন। একই সময়ে গত বছর পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১৪ কোটি ৬ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছরের একই সময়ে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
একই চিত্র দেখা গেছে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে। এখানে চলতি বছরের চার মাসে ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়েছে। গত বছর যা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ৭৫৫ মেট্রিক টন। অবশ্য পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে আমদানি কিছুটা বেড়েছে। গত বছর এই বন্দরে আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮০৯ মেট্রিক টন পণ্য। এ বছরের চার মাসে এসেছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন।
যশোরের ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক নতুন কিছু নীতিমালা আরোপ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, আগে পণ্য আমদানির পর এলসির (ঋণপত্র) টাকা পরিশোধ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন অগ্রিম টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। পচনশীল পণ্য আমদানিকারকেরা অন্য বন্দর দিয়ে আমদানি করছেন। এ ছাড়া ডলার–সংকটের কারণে এলসি করার পরিমাণও বেশ কমেছে।
এদিকে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে চার মাসে ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে গত বছরের এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৮৯ হাজার ৮৫৮ মেট্রিক টন পণ্য।
রপ্তানিনির্ভর কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দরের ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ২৪ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন পণ্য। চলতি বছরের একই সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৪ হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন।
কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আজম খান নোমানের মতে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিবিরবাজার স্থলবন্দরে পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তাঁর চাওয়া, সব সংকট কাটিয়ে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক।
এদিকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম প্রায় স্বাভাবিক থাকলেও এক সপ্তাহ থেকে আলু ও পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে অনেক ব্যবসায়ী কাঁচামাল হিসেবে আলু ও পেঁয়াজের এলসি (ঋণপত্র) খুলছেন না।
এদিকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম প্রায় স্বাভাবিক থাকলেও এক সপ্তাহ থেকে আলু ও পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে।
ভিসা বন্ধে যাত্রী কমছে
দেশের ৯টি স্থলবন্দরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই দেশের মধ্যে মানুষ যাতায়াত তিন ভাগের দুই ভাগে নেমে এসেছে। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৯২ হাজার ১১৭ জন দুই দেশে যাতায়াত করেছেন। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ৯১৫ জন।
পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৯ হাজার ৮৫০ জন যাতায়াত করেছেন। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৭ হাজার ৭২১ জন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া দিয়ে চলতি বছরের চার মাসে যাতায়াত করেছেন ৭১ হাজার ৬৯৯ জন। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪১৭ জন।
কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর দিয়েও যাত্রী যাতায়াত কমেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমিগ্রেশন পুলিশের এক সদস্য জানান, এখন যাঁরা ভারতে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ৫ আগস্টের আগে ভিসা পেয়েছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বেশির ভাগ যাত্রীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

গত সোমবার সকালে দুই ঘণ্টা অবস্থান করে বিবিরবাজার স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন দিয়ে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশিকে পারাপার হতে দেখা গেছে। ৫ আগস্টের পর ভিসা পেয়েছেন এমন কোনো বাংলাদেশিকে এই সময়ে পারাপার হতে দেখা যায়নি।
বিবিরবাজার কাস্টমস স্টেশনে কথা হয় কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর রামপুর গ্রামের জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছয় মাস আগে ভিসা পেয়েছি। আর তিন দিন মেয়াদ বাকি আছে। তাই আগরতলা ঘুরতে যাচ্ছি। অন্যান্য সময়ের মতোই যাওয়া যাচ্ছে, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’