ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠের জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মিথ্যা বলা, দুর্নীতি ও লুটপাট করা বিএনপি নেতাদের অভ্যাস। দলটির কোনো একজন নেতা আছেন, সারাদিন মাইক লাগিয়ে বসে থাকেন। বাংলাদেশকে নাকি আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ময়মনসিংহে একযোগে ১০৩টি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন কি বাংলাদেশ ধ্বংসের নমুনা?’
গতকাল শনিবার ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় জনসভায় শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কে দিয়েছে এই মোবাইল ফোন? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই মোবাইল ফোন দিয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াইফাই পৌঁছে গেছে। এসবই ডিজিটাল বাংলাদেশ।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সরকার ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে। যাদের ঘরবাড়ি ও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, রাস্তার পাশে পড়ে থাকে– তাদেরও ঘরবাড়ি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, আগামী দিনে দেশে একজন মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। এরই মধ্যে ৩৫ লাখ মানুষকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যে আরও ৪০ লাখ মানুষ ঘর পাবে।
প্রধানমন্ত্রী দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে জনসভাস্থলে পৌঁছান। তাঁকে একনজর দেখার জন্য মানুষ সকাল ১০টা থেকেই জনসভাস্থলে আসতে থাকেন। দুপুর ২টার আগেই কানায় কানায় ভরে যায় পুরো এলাকা। ওই সময় জনসভাস্থল রূপ নেয় জনসমুদ্রে। জনসভা মঞ্চে যাওয়ার আগে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমানের সঞ্চালনায় প্রায় ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ সমাপ্ত ৭৩টি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং প্রায় ২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপির আমলে ৪১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ১৯৯৬ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার বিনা পয়সায় বই দেওয়া থেকে শুরু করে উপবৃত্তি ও বৃত্তি দেওয়ায় সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশে উন্নীত করেছিল। পরে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গিয়ে সাক্ষরতার হার কমিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। এর কারণও আছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নাকি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছিলেন শুধু অঙ্ক আর উর্দুতে। উর্দু পাকিস্তানের ভাষা। এটা তাঁর প্রিয় ভাষা। টাকা গোনায় অঙ্ক লাগে।
তাই তিনি ওই দুটো ভালো বোঝেন। আর জিয়াউর রহমান ছিলেন ম্যাট্রিক পাস। তাঁদের ছেলে বিভিন্ন স্কুলে কয়েকবার এক্সপেল হয়ে কোনো এক অখ্যাত জায়গা থেকে নাকি সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। তারা বোমা মারা, গ্রেনেড হামলা, লুটপাট, মানি লন্ডারিং, টাকা চুরি, দুর্নীতি ও এতিমের অর্থ আত্মসাতে এক্সপার্ট। বাংলাদেশের মানুষ লেখাপড়া শিখবে, উন্নত হবে– সেটা তারা চায় না। তারা ২০০১ সালে লুটপাট, সন্ত্রাস, বোমা হামলা, বাংলাভাই ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল; মানুষ হত্যা করেছিল। তাদের অত্যাচারে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ।
জনসভা মঞ্চে এসে পৌঁছালে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ফুল ও নৌকা প্রতীকের রেপ্লিকা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও গারো ওয়ানগালা নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জনসভার আনুষ্ঠানিকতা।
এদিকে, জনসভাস্থলে ঠাঁই না হওয়ায় আশপাশের সড়কগুলোতে অবস্থান নেয় উৎসুক মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বিকেল ৩টা ৫৪ মিনিটে ভাষণ শুরু করলে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সার্কিট হাউস ময়দান ও এর আশপাশ। ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও জামালপুর থেকে লাখ লাখ মানুষ সড়ক, রেল ও নৌপথে জনসভায় আসে। আটটি বিশেষ ট্রেনে করেও নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জনসভায় যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতেই সমবেত নেতাকর্মীকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় আমার মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে, তিন ছোট ভাইকে। আমার ১০ বছরের ছোট ভাইটিও রেহাই পায়নি। আমাদের পরিবারের ১৮ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীর চোখের কোণে পানি জমে। তিনি আবেগাপ্লুত হন। তিনি বলেন, ছোট বোন শেখ রেহানা আর তিনি বিদেশে ছিলেন বলেই বেঁচে যান। কিন্তু তাঁদের ছয়টি বছর দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। জাতির পিতাকে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁদের বারবার বাধা দিয়েছে। পরে তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যখন তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে, তখনই তিনি দেশে ফিরে আসার সুযোগ পান। আর শুধু জনগণের ওপর ভরসা করেই তিনি মা, বাবা, ভাই সব হারিয়ে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে দেশে এসেছিলেন।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নতি, মানুষের জীবনকে আরও উন্নত ও মর্যাদাশীল করাই তাঁর লক্ষ্য। এই স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছেন। তিনি স্বাধীনতার মাসে ময়মনসিংহবাসীকে ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প উপহার দেওয়া ও ভিত্তিপ্রস্তর করা ৩০টি প্রকল্পের কথা জানিয়ে বলেন, ‘এগুলো যত্ন করে রাখবেন।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ময়মনসিংহকে নতুন বিভাগ হিসেবে ঘোষণা করার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি বিভাগের মতো এই বিভাগেও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, আলাদা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য বিভাগের মতো প্রতিটি উন্নয়ন কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিকল্পনার অনেক কাজই হয়তো এর মধ্যেই করা সম্ভব হতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে হয়নি। এ সময় সরকার সবার জীবন সুরক্ষার জন্য বিনা পয়সায় করোনা টিকা দিয়েছে, যা কোনো উন্নত দেশও দিতে পারেনি, ধনি দেশও দেয়নি।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনকালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ওই সময়ে বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচারে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলা হয়েছিল। অনেক মানুষ নিহতও হয়েছিল। ওই সময়ে প্রতিনিয়ত সারাদেশে বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি ও লুটপাটই ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের কাজ। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁর ছেলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে দল গঠন করে। সেই দল শুধু লুটপাট, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানুষ খুন, নির্যাতন ও অত্যাচার করতে পারে। ওদের ক্ষমতায় যাওয়া মানেই হচ্ছে মানুষের ওপর নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনা করা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মানুষকে উন্নয়ন উপহার দেয়। আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে উন্নয়ন উপহার দেয়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে নির্যাতন করে। তিনি প্রতিটি এলাকায় স্কুল নির্মাণ, নতুন নতুন স্কুল ভবন তৈরি, ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ, মাদ্রাসা-স্কুল এমপিওভুক্ত ও শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করায় স্বাক্ষরতার হার ৭৫.২ ভাগে উন্নীত হয়েছে বলে জানান। ভাষণের শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নেই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’
এ জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মানুষ বিএনপিকে চায় না। ধানের শীষের আরেক নাম পেটের বিষ, সাপের বিষ। তিনি আরও বলেন, মানুষ ভালো আছে। কিন্তু ফখরুল সাহেবরা ভালো থাকতে দেবে না। মানুষ খুশি থাকলে বিএনপি বেজার। মানুষ খুশি হলে ভোট কমে যায় বলেই বিএনপি খুশি নয়। তারা এতদিন দৌড়াতে দৌড়াতে এখন দাঁড়িয়ে গেছে। মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে গেছে। পথ হারিয়ে পদযাত্রার পথিক মানববন্ধনে দিশেহারা পথিক। কোথায় যাবে এখন? ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। একদিকে লন্ডনের ফরমান, অন্যদিকে টাকা ওয়ালাদের টাকা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দিশেহারা। চোখে অন্ধকার দেখছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্তর সঞ্চালনায় জনসভায় আরও বক্তব্য দেন সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল প্রমুখ।