
ভুক্তভোগীদের হাত পেছন দিকে বাঁধা। সংখ্যায় ১২৫। কারও শরীরে বেয়নেটের আঘাত, শ্বাসরোধের চিহ্ন, কাউকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। ঘটনাস্থল ঢাকা শহরের পাশের একটি মাঠ।
স্থানীয় বাসিন্দারা লাশগুলো দেখতে পান ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর; পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দুদিন পর। ১৯ ডিসেম্বর এ ঘটনা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, লাশগুলো ছিল চিকিৎসক, অধ্যাপক, লেখক ও শিক্ষকদের। আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে (১৪ ডিসেম্বর) তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা।
টাইমসের প্রতিবেদনে ঘটনাস্থলের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে লেখা হয়, মাঠের পাশের একটি কারখানায় বেশ কয়েকজনকে হত্যার পর লাশ গর্তে ফেলে রাজাকাররা। স্থানীয় বাসিন্দারা যখন ভিড় করছিলেন, তখনও কারখানাটিতে কয়েকজন রাজাকার ছিল। এক পর্যায়ে ভারতীয় টহল দলের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। দুজন ধরা পড়লে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
মাঠটিতে কিছু লাশ পড়ে ছিল রক্তমাখা পানির মধ্যে। ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় প্রায় চেনার উপায় ছিল না। একটি ইটভাটার গর্তে থাকা লাশগুলো যখন স্বজনরা শনাক্ত করতে যান, তখন পাশের মসজিদে লুকিয়ে থাকা রাজাকাররা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। নিউইয়র্ক টাইমস আরও লিখে, ‘আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়ে সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
দুই জেনারেলের বয়ান
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি ছিলেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর অধিনায়কত্বে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড চালায়। যুদ্ধ শেষের বেশ কয়েক বছর পর তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে উঠে আসে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রসঙ্গ।
১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। নিয়াজীর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছে ‘পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ নামের বইয়ে।
সাক্ষাৎকারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিয়াজী দাবি করেন, বুদ্ধিজীবী নয়, যুদ্ধের সময় তাঁর মাথাব্যথা ছিল ‘অস্ত্রধারী দুশমনদের’ নিয়ে। বুদ্ধিজীবীদের তালিকার বিষয়ে তিনি জানতে পারেন আলতাফ গওহরের (আইয়ুব খানের সময়কার তথ্য সচিব) কাছ থেকে। গওহর জানান, ফরমানের (পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা) কাছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা আছে। পরে তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ফরমানের কাছে একজনকে পাঠান। তাঁর অনুরোধে ফরমান তালিকা থেকে দুজনের নাম বাদ দিয়েছিলেন।
তবে ভিন্ন বয়ান উঠে এসেছে একই বইয়ে প্রকাশিত রাও ফরমান আলীর (মেজর জেনারেল ছিলেন) সাক্ষাৎকারে। ফরমানের দাবি, আত্মসমর্পণের আগে ৯ কিংবা ১০ ডিসেম্বর জেনারেল শামসের (পিলখানার তৎকালীন সিএএফও) দেখা করতে বলেন। বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে বৈঠক করা। পথে শামসের বলেন, কিছু লোককে গ্রেপ্তার করতে হবে। কারণ জানতে চাইলে তিনি নিয়াজীকে জিজ্ঞেস করতে বলেন। ওই লোকগুলোর সবাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী।
পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের পর গভর্নর হাউসের লিখিত দলিলে বুদ্ধিজীবীদের নাম পাওয়া গিয়েছিল। যে কারণে ফরমান আলীকে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী করা হয়। সাক্ষাৎকারে ফরমান আলী দাবি করেন, গভর্নর হাউসে তখন অনেক লোক আসত দেখা করার জন্য। তারা এ ধরনের তালিকা দিত।
হত্যা করল কারা
নিউইয়র্ক টাইমসের মতো বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাও ১৯ ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। লেখা হয়, ১৪ ডিসেম্বর রাতে কিছু মুখোশধারী লোক বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে হানা দেয়। ১৭ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয়রা বুড়িগঙ্গার পাশের একটি সড়কের ধারের বাঙ্কারে বেশ কয়েকজনের লাশ দেখতে পান। তাদের সবার চোখ উপড়ানো ছিল। হাত ছিল পেছনে বাঁধা। শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, ডা. রাব্বি ও মুনির চৌধুরী। তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল আলশামস ও আলবদরের সদস্যরা। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি সেনা।
একই দিন ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘পাকিস্তান সামরিক জান্তার পতন ও তার দখলদার সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্ববর্তী কয়েক দিনে তাদের পক্ষপুষ্ট দোসর জামায়াতে ইসলামী ও সমমনোভাবাপন্নদের বাহিনী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ঢাকার যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, লেখক, চিকিৎসক, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানীকে গ্রেপ্তার ও অপহরণ করিয়াছিল, তাঁহাদের প্রায় সকলেই এই জঘন্যতম ঘাতকের হাতে প্রাণ হারাইয়াছেন।’
জেনারেল নিয়াজীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তাঁর কাছে রাজাকার, আলবদর, আলশামসের হত্যাকাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুনতাসীর মামুন। নিয়াজীর ভাষ্য, তিনি জানতেন না। যুদ্ধের সময় তাঁর ৩৮ হাজার সৈন্য ছিল। তারা অকাতরে মারা পড়ছিল। মৃত সৈনিকদের স্থান পূরণ করতে হতো। তাই তিনি এসব আলবদর ও আলশামসদের বিভিন্ন সেনা ডিভিশনে নিয়োগ দিতেন। তাদের অনেকে দলছুট হয়ে পালিয়ে গিয়ে এটা-সেটা করেছে।
সাক্ষাৎকারে নিয়াজী বলেন, ‘তাদের একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়োগ করা হয়। ব্যবহারও করা হয় সেভাবেই। তাদের হাতে অস্ত্রও দেওয়া হয়েছিল।’
সূত্র: সমকাল