গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র বাহিনী

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব)
  ২১ নভেম্বর ২০২৩, ২১:৫৭

২১ নভেম্বর- সশস্ত্র বাহিনী দিবস
১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল বাংলার জনগণের সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও একাত্মতা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণাময় উদাহরণ। দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের স্বাধীনতা, ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্য শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়া প্রয়োজন। মনে করিয়ে দেয়, তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার কথা। প্রতিবার দিবসটি আমাদের পুনরুত্থানের পরম লগ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং জাতির স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও জনতার চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন এবং আমাদের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার মূর্ত প্রতীক
২১ নভেম্বর- সশস্ত্র বাহিনী দিবস। যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যসহ তদানীন্তন মুক্তিবাহিনীর সব সদস্যকে এক সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে আনা হয় এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে সার্বিক ও ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ রচনা করা হয়। জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওই দিন আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা বিধায় ২১ নভেম্বর জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে এই দিবস ও তার ঘটনাবলির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অপরিসীম এবং বহুমুখী। রাষ্ট্রীয় জীবনে যার অবদান এখনো বিদ্যমান ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ভবিষ্যতেও দিনটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অনুপ্রাণিত করবে এবং আলোর পথ দেখাবে। উল্লেখ্য, ১৯৮২ সাল থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 
বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ২১ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২১ নভেম্বর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাত্মক সহায়তা ও সমর্থনে বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আক্রমণের সূচনা করে। ওই আক্রমণের সাফল্যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে সারাবিশ্বের রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী।
এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উভয় দেশের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী। সুতরাং ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সার্বিক পরিকল্পনার অংশবিশেষ, যার প্রেক্ষিত তৈরি করা হয় ধাপে ধাপে। 
১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় যশোরের চৌগাছা সীমান্ত এলাকায়। প্রকৃতপক্ষে এখান থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধ। ২০ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং বাংলাদেশের ৮নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি, ১৪টি পিটি-৭৬ ট্যাংকের ছত্রছায়ায় বয়রা সীমান্ত পেরিয়ে চৌগাছার গরিবপুর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। ২১ নভেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে পাকিস্তান বাহিনীর ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, এক স্কোয়াড্রন এম-২৪ সেফি ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় যৌথ বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। তিন ঘণ্টা প্রচ- যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এখানে তাদের ১১টি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং অফিসারসহ ৩০০ সেনা হতাহত হয়। হেনরি কিসিঞ্জারের মতে, ২১-২২ নভেম্বর বয়রা-চৌগাছা সীমান্তে উভয় পক্ষের ট্যাংক, বিমান ও গোলন্দাজ সংঘর্ষের দিনই চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করার দিন। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে চৌগাছার ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ নিয়ে ভারতে পিপ্পা নামে একটি চলচ্চিত্র (হিন্দি) তৈরি হয়েছে। 
প্রতিবছর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে থাকে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানমালায় অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে (বর্তমানে এক বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়) প্রচুর জনসমাগম ঘটে। বিভিন্ন স্থানে নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ এই উপলক্ষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এই অনুষ্ঠানমালায় জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৈনিক-জনতার মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনী দিবসের তাৎপর্য ও সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকা- জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য প্রতিবছরই জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোয় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং টেলিভিশন চ্যানেলে অনির্বাণসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। এতে জনসাধারণ সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বিশদভাবে জানার সুযোগ পেয়ে থাকে। 
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অন্যতম আকর্ষণীয় কর্মসূচি হলো এই দিবস উপলক্ষে ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাস, নৌবাহিনী ঘাঁটি ও বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে আয়োজিত হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। পাতাঝরা হেমন্তের মনোরম বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জ, প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদসহ দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট আমন্ত্রিত অতিথিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বৃক্ষের শোভা ও সরোবরঘেরা অপরূপ স্থাপত্যময় সেনাকুঞ্জের খোলা চত্বরের সামনে সবুজ ঘাসের গালিচায় এখানে চমৎকার ঐক্য, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের আবহ তৈরি হয়।
আমন্ত্রিত নাগরিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে। উল্লেখ্য, সেনাকুঞ্জ (বহুমুখী মিলনায়তন ও সিভিল কমপ্লেক্স) নির্মিত হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমানের উদ্যোগে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এটি ১৯৮৯ সালের ২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
বর্তমানে প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে প্রণীত ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন চলছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিকে যুগোপযোগী করে ‘প্রতিরক্ষা নীতি-২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছর সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে অত্যন্ত প্রশংসনীয় অগ্রগতি লক্ষ করা গিয়েছে। বিশেষত, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তির সংযোজনের ক্ষেত্রে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন তিন বাহিনীর সমন্বয়, ব্যাপক যৌথ অনুশীলন ও অস্ত্র সরঞ্জামাদি ক্রয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা।
উল্লেখ্য, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে জাতীয় সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (এএফডি) দেওয়া এক প্রতিবেদনে গত ৫ বছরে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের যে সকল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা জানানো হয়। এখানে উল্লেখ করা হয় যে, গত ৫ বছরে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও মানববিহীন ড্রোনসহ অন্তত ২৩ ধরনের নতুন আধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে। 
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন শক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা, বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব, রোহিঙ্গা সমস্যা, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনীতিগত গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী ও সুসজ্জিতকরণ বিষয়টি যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ‘ক্রেডিবল ডেটারেন্স’ (যে শক্তিশালী অবস্থান অন্য দেশকে বাংলাদেশ আক্রমণে নিরুৎসাহ করবে) অর্জন করতে হবে। এটিই বাস্তবতা।
১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল বাংলার জনগণের সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও একাত্মতা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণাময় উদাহরণ। দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের স্বাধীনতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়া প্রয়োজন। মনে করিয়ে দেয়, তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার কথা। প্রতিবার দিবসটি আমাদের পুনরুত্থানের পরম লগ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং জাতির স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও জনতার চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন এবং আমাদের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার মূর্ত প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। আগামী দিনেও মাতৃভূমির অখ-তা রক্ষা তথা জাতীয় যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রস্তুত থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জনগণের সঙ্গে একাত্ম হওয়া ও জনসম্পৃক্ততার উপদেশ দিয়েছেন। সব ধরনের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র, দেশ ও সশস্ত্র বাহিনী সবার, সমগ্র জাতির সম্পদ। সুতরাং সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দেশমাতৃকার সেবায় সদা সর্বত্র অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত থাকবে। এই হোক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞা। 
লেখক : গবেষক