যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম-নীতি

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কী করতে পারি

এরশাদুল আলম প্রিন্স
  ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৫

শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের দাবি– হয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমান, না হয় বেতন বাড়ান। তাদের দাবির ন্যায্যতা প্রশ্নাতীত।
চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক পোশাক নীতি প্রণয়ন করেছে। এটি পোশাক খাতে এক ধরনের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাও বটে। যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এ নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে। ১৬ নভেম্বর এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করবেন, হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রসঙ্গক্রমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের এক নেতা কল্পনা আক্তারের নামও উল্লেখ করেন।
২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ব্রিফিংয়েও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানানো হয়েছে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প তাদের নজরদারিতে আছে।
শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্যই এ পোশাক নীতি। তবে, এ পোশাক নীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য না, সব দেশের জন্যই প্রয়োগযোগ্য।
দেশের সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনের জেরে বেশ কিছু পোশাক কারখানা এখনও বন্ধ রয়েছে। পুনরায় চালু হওয়া কারখানাগুলোতে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ নিয়েই কারখানাগুলোতে কাজ ‍শুরু হয়েছে। এদিকে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংঘাত আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারেও প্রভাব ফেলেছে।
আমাদের পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপ আর একক দেশ হিসেবে আমেরিকা। দেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থান ও ভূমিকা একই রকম। তারা সবাই বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চায়। এদিকে সরকার সংলাপ-সমঝোতার পথে না গিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছে। এ বিষয়টি আমাদের পোশাক রফতানি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পোশাক নীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক বাজারকে বয়কট করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি অন্যান্য ক্রেতাও একই পথ ধরলে আমাদের পোশাক রফতানি বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আবার এ পোশাক নীতি কোনও পোশাক কারখানা বা কোনও মালিকের ওপর ব্যক্তিগতভাবেও প্রয়োগ হতে পারে। যেসব কারখানা আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দিনের পর দিনে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে আসছে, সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপরও এ পোশাক নীতি প্রয়োগ হতে পারে। এতে ওইসব কারখানা থেকে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক আমদানি বন্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে ওই সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এই নীতি অনুযায়ী শ্রমিকদের যারা হুমকি দেবে, শ্রম ইউনিয়ন ও অধিকারের বিপক্ষে যারা কাজ করবে, তাদের ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা (বাণিজ্যিক ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা) দেওয়া হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পোশাক নীতি দেশের পোশাক রফতানিকারকদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। তারা এ বিষয়ে সরকারকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু, এ বিষয়ে সরকার ও শিল্পমালিকদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে।  
প্রায় চার দশক ধরে দেশের পোশাক শিল্প ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে। এতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছে। বেশ কিছু কারখানা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী পরিচালিতও হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা এসব কারখানাকে কমপ্লায়েন্ট হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশের অধিকাংশ কারখানা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ কারখানাতেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন নিদারুণভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু এদের জন্য কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।  
দেশের শ্রম আইন তথা শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে একটি বড় অভিযোগ হলো, এখানে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে  কাজ করতে দেওয়া হয় না। শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠার বিরুদ্ধেও মালিক পক্ষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর নানাবিধ কারণও আছে। মালিক ও শ্রমিক উভয়পক্ষ থেকেই শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
কখনও এগুলো মালিকপক্ষের হয়ে কাজ করে, আবার কখনও এগুলো শ্রমিক অধিকার আদায়ের নামে মালিকপক্ষের ওপর অযৌক্তিক জোর খাটায়। অর্থাৎ শ্রমিক সংগঠনগুলো এখানে আদর্শ দরকষাকষি সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত পরিবেশ ও প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের যেভাবে দমন করা হয়েছে তা শ্রমিক অধিকারের প্রতি অবমাননাকর। বহির্বিশ্ব বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেয়নি সেটি স্পষ্ট। ২০ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বক্তব্যেও সেটি স্পষ্ট।
দেশের বিদ্যমান শ্রম আইনটিও যথেষ্ট শ্রমিকবান্ধব নয়। শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে শ্রম অধিদফতরের অনুমতি নিতে হয়। শ্রম অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে এটি একটি নিয়ন্ত্রণমূলক বিধান। শ্রম অধিদফতরের বারান্দা ঘুরে শ্রম আদালতে যেতে হবে এ বিধানটি শ্রমিক অধিকার পরিপন্থি। এসব নিয়ন্ত্রণমূলক বিধান বাতিল করা জরুরি। আদালতের দরজা সবার জন্য সবসময় খোলা রাখতে হবে। এরকম বিধান আরও আছে, যা সংশোধন করা জরুরি।  
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির হার কমছে (গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের তুলনায় ৩ শতাংশ কম)। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এ অবস্থানকে উন্নীত করা বা ধরে রাখার জন্য পোশাক শিল্প মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পোশাক নীতিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থায় পোশাক শিল্পকে কোনোভাবেই হুমকির মধ্যে ফেলা যাবে না। ইতোমধ্যে এ খাতে মূলধনী যন্ত্র ও কাঁচামাল আমদানির হার কমছে। ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। আবার গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, পোশাক খাত এমনিতে হুমকির মধ্যে আছে। নতুন কোনও চ্যালেঞ্জের মধ্যে যাতে না পরে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
সস্তা ও সহজলভ্য শ্রমের জন্যই দেশে পোশাক শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে শ্রমিক অধিকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ পোশাক শিল্পেরই ক্ষতি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পোশাক নীতি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার। তবে, এ নীতির বেশ কিছু কর্মপরিধি আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র যদি একসঙ্গে কাজ করে তবে বর্তমান সংকটকে সম্ভাবনায়ও রূপান্তরও করা সম্ভব। পোশাক নীতি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রম সংগঠন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবে। এ জন্য বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা ওই দেশের শ্রমিক ইউনিয়ন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাজ করবে। এছাড়া তারা বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতিসংঘ, জি-২০-এর মতো বহুজাতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও কাজ করবে। যু্ক্তরাষ্ট্র দক্ষ শ্রমিক তৈরির অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতেও কাজ করবে। এছাড়া তাদের বাণিজ্য চুক্তিগুলো যাতে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করে সেদিকেও লক্ষ রাখবে। কাজেই বাংলাদেশ সরকার ও পোশাক মালিকরা যদি যুক্তরাষ্ট্র তথা অন্যান্য ক্রেতার সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে তবে পোশাক শিল্পের অনেক সমস্যাই কেটে যাবে। এই পোশাক নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, জি-২০ বা অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করারও সুযোগ সৃষ্টি হলো।
পোশাক শ্রমিকদের বর্তমান দাবি বেতন বাড়ানো। অন্যান্য সব দেশের চেয়ে আমাদের শ্রমিকরা কম মজুরি পান। এটি কাম্য নয়। মজুরির প্রশ্ন উঠলেই শ্রমিকদের অদক্ষতার অজুহাত দেওয়া হয়। অথচ অদক্ষ শ্রমিকের জন্য অর্ডার সরবরাহ করা যায়নি এমনটি সচরাচর হয় না। পোশাক রফতানিতে চীনের পরই বাংলাদেশের স্থান। অথচ চীনে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩০৩ ডলার আর আমাদের দেশে ১১৩ ডলার।
কাজেই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করতে মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্তোষজনক কর্ম পরিবেশ ও মজুরি নিশ্চিত করা একটি কমপ্লায়েন্ট পোশাক কারখানা তথা পোশাক শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। এরপরে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা আসে। নতুন পোশাক নীতির ভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। একটি টেকসই পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।  
লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক