পরিসংখ্যান ব্যুরো তথা বিবিএস হইতে বুধবার প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনটিতে ১৫ বৎসরের কম বয়সী বালিকাদের বিবাহের হার পূর্বের বৎসরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়া যাইবার চিত্র উদ্বেগজনক হইলেও বিস্ময়কর নহে। গত বৎসর জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল প্রকাশিত ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি’ প্রতিবেদনেও দেখা গিয়াছিল, বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশ কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নহে, সমগ্র মহাদেশে শীর্ষে রহিয়াছে।
বিবিএস প্রকাশিত প্রতিবেদনেও দেখা যাইতেছে, বিবাহের ‘আইনগত’ বয়স ১৮ বৎসরের পূর্বেই ৪০ শতাংশের অধিক বালিকা দাম্পত্যজীবনে প্রবেশ করিতেছে এবং সেই হার চলতি দশকে ক্রমাগত বাড়িয়া চলিতেছে। স্বীকার্য, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ হ্রাসে আইনি কাঠামো ও প্রশাসনিক উদ্যোগ কদাচ স্বল্প নহে। গড়িয়া উঠিতেছে সামাজিক প্রতিরোধও। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণের কারণে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল হইতেও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থী কিংবা তাহার সহপাঠীগণ প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমে সহযোগিতার জন্য হস্ত বাড়াইতে সক্ষম হইতেছে। তাহার পরও এই সামাজিক প্রপঞ্চ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি হইয়া চলিবার চিত্র উদ্বেগজনক না হইয়া পারে না।
এই আশঙ্কা অমূলক হইতে পারে না যে, ২০১৭ সালে কার্যকর বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৯ নম্বর ধারায় ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ যুক্ত হইবার কারণেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়া চলিতেছে। সেইখানে বলা হইয়াছিল, বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং আদালতের নির্দেশ ও অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইতে পারিবে। আমাদের স্মরণে রহিয়াছে, মানবাধিকারকর্মীরা তখন হইতেই ধারাটির বিষয়ে আপত্তি জানাইয়া আসিতেছিলেন। উহাতে উদ্বেগ জানাইয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টও বিবৃতি প্রদান করিয়াছিল।
খোদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান গত বৎসর মে মাসে এক আলোচনা সভায় ঘোষণা দিয়াছিলেন যে, তাঁহার সংস্থা ধারাটি সংশোধনের সুপারিশ করিবে। তাঁহার এই বক্তব্যের সহিতও আমরা অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে ঐকমত্য প্রকাশ করিয়াছিলাম যে, আইনটির ১৯ ধারা সুনির্দিষ্ট না হইয়া পরিধির ব্যাপকতার কারণে বাল্যবিবাহ উৎসাহিতই করিতে পারে। সেই আশঙ্কাই কি গত কয়েক বৎসর ধরিয়া বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিতেছে?
আমরা মনে করি, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৯ নম্বর ধারাটি অবিলম্বে সংশোধন বা সুনির্দিষ্ট করা উচিত। কারণ ১৮ বৎসরের পূর্বে নারীর বিবাহ কেবল মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন নহে; বাল্যবিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে মাতৃত্বের কারণে যেইরূপ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈয়ারি হয়, সেইরূপ শিক্ষা ও কর্মজীবনও বিরত এমনকি রহিত হইবার আশঙ্কা রহিয়া যায়। সামাজিক বাস্তবতার কথা স্মরণে রাখিতে হইবে বৈকি।
গত বৎসরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়াছিল, দেশের ৭১ শতাংশ কিশোরী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার কারণে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করিতে পারে না। অনেক অভিভাবকই বাল্যবিবাহের মাধ্যমে উহার উপশম খুঁজিতে গেলে দোষ দেওয়া যাইবে না। কিন্তু আইনের অস্পষ্টতা থাকিলে আলোচ্য ধারার অপব্যবহারও হইতে পারে। স্মরণে রাখিতে হইবে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যত উন্নতিই করি না কেন; বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারিলে সকল অর্জনই নড়বড়ে হইয়া পড়িতে পারে।