মধ্যপ্রাচ্যে আপনার রমজান থেকে পালাবার উপায় অত্যন্ত সীমিত। তাই সেখানে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে অমুসলিমদের অংশ নেওয়া একেবারে স্বাভাবিক না হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অবশ্য ইউরোপের খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে গল্পটি একটু ভিন্ন। তবে এটি এখন আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। একজন আলেম বা প্র্যাকটিসিং মুসলিমের কাছে কথাটা একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু ইরাকে বসবাসকারি ৫৩ বছর বয়স্ক খোলুদ খারদৌমের কাছে বিষয়টি বেশ পরিষ্কার। বাগদাদভিত্তিক এই লেখক বলেন, 'রমজান মাসটা কেবল ধর্ম নিয়ে নয়। এটি পরিবেশ এবং মানুষের একত্রিত হওয়ার ঐতিহ্য সম্পর্কেও”।
তিনি ডয়চে ভেলে (DW) নিউজ চ্যানেলকে বলেন, ''ইরাক একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ৷ কিন্তু যেসব এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একসঙ্গে বসবাস করে, সেখানেও আপনি প্রায়শঃই অমুসলিমদেরকেও রমজান মাসের ছুটির দিন উদযাপনে অংশ নিতে দেখবেন৷ বিশেষত, "ইফতার", অর্থাৎ সূর্যাস্তের খাবার যেখানে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার একত্রিত হয়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের উপবাস ভাঙতে হয়, এটি একটি সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।
খারদৌম আরো বলেন, “অনেক সময় খ্রিষ্টানরা তাদের তৈরি করা এক বাটি বা এক প্যাকেট মিষ্টি প্রতিবেশী মুসলিমদের কাছে পাঠায়। মাঝে মাঝে মুসলমানরাও খাবার পাঠায়। অথবা এই সম্প্রদায়ের সবাই একসঙ্গে রোজা রাখে। এই বিষয়গুলো শেয়ার করতে পেরে সত্যিই ভালো লাগছে”। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্রও একই ধরনের আরো কাহিনী রয়েছে। কায়রোর দক্ষিণে আসিউত শহরে বসবাসকারী ৫০ বছর বয়সী মিশরীয় নারী উম্মে আমির বলেন, “আমার সবচেয়ে পুরনো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন মুসলিম, তাই আমরা কিছু রীতিনীতি শেয়ার করি। যেমন, আমি রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা রাখব, অতঃপর তার পরিবারের সাথে সেটা ভঙ্গ করে ইফতার করব”।
বৈরুতে রোজা রাখা ৩৪ বছর বয়সী রিতা নামের এক লেবানিজ মহিলা বলেন, “আমি খ্রিস্টান, কিন্তু আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই আমার অনেক মুসলিম বন্ধু ছিল এবং আমি কখনোই আমার ধর্ম ভিন্ন, এই ব্যাপারটার ওপর খুব বেশি জোর দিইনি”। মধ্যপ্রাচ্য না হয় বোঝা গেল, পশ্চিমা দেশগুলিতে অবস্থা কি রকম?
যেহেতু এই তিনজন নারীই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বাস করেন, সেহেতু তাদের অভিজ্ঞতা সেখানে বসবাসকারীদের কাছে খুব একটা বিস্ময়কর হবে না। সর্বোপরি, সেখানকার অমুসলিমদের জন্য রমজানকে উপেক্ষা করা ঠিক ততটাই কঠিন যতটা ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় মুসলমানদের ক্রিসমাস এড়ানো কঠিন। তবে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে রমজান ধীরে ধীরে আরও হাই-প্রোফাইল ছুটির দিনে পরিণত হচ্ছে।
গত বছর ইউরোপের প্রথম বড় শহর হিসেবে রমজানের আলোয় সাজানো হয় লন্ডনকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন এই বছর লন্ডনের উদাহরণ অনুসরণ করেছে, এবং রমজানের আলোকসজ্জা স্থাপনকারী প্রথম বড় জার্মান শহর হয়ে উঠেছে। এই সপ্তাহে অস্ট্রিয়ার কারিন্থিয়া রাজ্যে এক হাজারেরও বেশি লোক "উন্মুক্ত ইফতার" পার্টিতে একত্রিত হয়েছিল। সেখানে ঐ সম্প্রদায়ের সকল সদস্যকে একসাথে রমজানের রোজা ভাঙার ইফতারি এবং তারপর ডিনার খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল - এমনকি যারা মুসলিম নয় তাদেরকেও এবং কেউ রোজা না রাখলেও। আয়োজকরা বলছেন, প্রতি বছর এই আয়োজন আরও বেশি মানুষকে আকর্ষণ করে। একজন অংশগ্রহণকারী আঞ্চলিক সংবাদপত্র ক্লেইন সাইটুংকে বলেছেন, "আমি এখানে এত অমুসলিম দেখতে পাব তা আশাই করিনি”।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উলফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক এস্থার-মিরিয়াম ওয়াগনার বলেন, “বৈচিত্র্য উদযাপনের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য সংস্থা এবং গির্জার আয়োজনে অবশ্যই ইফতারের সংখ্যা বেড়েছে”। ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ইসলামোফোবিয়া তদন্ত প্রকল্প “ব্রিজ ইনিশিয়েটিভ”-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক ফরিদ হাফেজ বলেন, “রমজানের উচ্চতর প্রোফাইলটি জনসাধারণের পরিসরে মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং সমতা বাড়ানোর বিষয়ের মধ্যেও অন্তর্নিহিত রয়েছে"।
উদাহরণ হিসেবে হাফেজ বলেন, “সেই ৯০-এর দশকে, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইট, তার কূটনৈতিক বিভাগে প্রথম ইফতারের আয়োজন চালু করেন”। তিনি ব্যাখ্যা করেন, "মার্কিন দূতাবাসগুলো মূলত (অনুষ্ঠান চলাকালীন) এক ধরনের কাঠামোগত সংলাপের জন্য মুসলমানদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। এরপর মার্কিন দূতাবাসগুলো তা ইউরোপের দেশগুলোতেও নিয়ে আসে। এরপর ইউরোপের দেশগুলোতেও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়। সুতরাং আপনাদের চ্যান্সেলর, প্রধানমন্ত্রী, ইন্টিগ্রেশনের মন্ত্রীরা সবাই এর মধ্যে জড়িত ছিলেন”।
রমজানের বাণিজ্যিক প্রভাবও মুসলমানদের পবিত্র মাসের প্রোফাইল বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। মুসলমানরা রমজান মাসে উপহার এবং পোশাক থেকে শুরু করে খাবার, এমনকি গাড়ি পর্যন্ত সমস্ত কিছুতে বছরের অন্যান্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই ২০২৩ সালের রমজানে ব্যয় হয়েছে ৬০ বিলিয়ন ডলারের (৫৫ বিলিয়ন ইউরো) বেশি। রমজানের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচারণা পরিবর্তিত হয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিবর্তন ও বৃদ্ধির লক্ষ্যবস্তু সম্ভবত সম্প্রদায়ের বাইরেও একটি বার্তা পাঠাচ্ছে।
তবে এর সবকিছুই পজিটিভ নয়। সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের অভিযোগও আছে। রমজানের প্রোফাইল নিয়ে উলফ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ওয়াগনারের আরেকটি তত্ত্ব ভাষা এবং প্রজন্মগত পরিবর্তনকে (generational change) ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সমাজভাষাবিদ (sociolinguist) হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়া ওয়াগনার বলেন, "যখনই কোন মানুষ বিকৃত উচ্চারণ (accent) ছাড়া কোনো ভাষায় ঠিকমত কথা বলে, তখনই সবার বোঝার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসে যে তারা আসলে অন্তর্ভুক্ত (actually belong), বাইরের কেউ নয়। আর ব্রিটেনে আমরা দেখছি ইংরেজিভাষী স্থানীয়-মুসলিম জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স এখন ৪০ থেকে ৫০-এর কোঠায়, তারা দেশ ও সমাজে নেতৃত্ব ও প্রভাবশালী অবস্থানে চলে যাচ্ছে”।
ফ্রান্সেও একই অবস্থা। সেখানে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, পরবর্তী প্রজন্মের ফরাসি মুসলমানরা মনে করেন যে তারা আরও খোলামেলাভাবে ধর্ম অনুশীলন করতে পারেন। ফ্রান্সের আরব ও ইসলামিক ওয়ার্ল্ডস সম্পর্কিত গবেষণা ও অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষক জামেল এল হামরি গত সপ্তাহে ফরাসী প্রভাবশালী পত্রিকা, “লে মন্ড”-কে বলেছিলেন, "আরও দৃশ্যমান [ধর্মীয়] অনুশীলনের মাধ্যমে, তরুণ ফরাসি ব্যক্তিরা সমাজের পুরোপুরি সদস্য হিসাবে তাদের মর্যাদা দাবি করে। তারা একাধারে ফরাসি এবং মুসলিম এই উভয় সত্ত্বাকেই অনুভব করে”। অবশ্য সবাই যে খুশি হয়, তা না। কিছু মুসলমান রমজানের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে খুবই বিরক্ত। রক্ষণশীল আলেমরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে অমুসলিমদের মোটেই এ সবে অংশ গ্রহণ করতে নেওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে উগ্র ডানপন্থী ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করেন যে, এই অনুশীলনটি তাদের প্রতিষ্ঠিত “সভ্যতা”-কে কবরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই সভ্যতাটি তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী সভ্যতা। কিছু সামাজিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব যারা রমজানের সময় রোজা রেখেছিলেন কিন্তু এটিকে এক ধরণের অনলাইন স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন, তাদেরকে এটি যে তাদের দেশের উপর সাংস্কৃতিক দখল, এসব বলা ও লেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে হাফেজ বা ওয়াগনার, দুজনেই বিশ্বাস করেন যে এই জাতীয় মতামতগুলি, যা অন্যের বিশ্বাস ব্যবস্থার সাথে ঘৃণা ও বিবাদ ঘটায়, তা কোন ধরণের স্বাচ্ছন্দ্য বহন করে নিয়ে আসে না, বরং তার সাথে সুন্দরভাবে মানিয়ে চলার সুবিধা অনেক বেশি ।
খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মুসলমানদের জন্য এটি হতে পারে তাদের সমাজকে আপন করে নেবার বিষয় ও সুযোগ। হাফেজ যুক্তি দেখান, "জনসাধারণের পরিসরে এই উৎসবকে অন্তর্ভুক্ত করায়, এক অর্থে, এটি [রমজান] হয়ে যায় সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ"। আর অমুসলিমদের জন্য রমজান সমাজের বৈচিত্র্যকে উদযাপন ও ব্যবস্থাপনার একটি বিষয় হতে পারে। "কারণ যখন আমাদের বৈচিত্র্যময় সমাজ থাকে, তখন আমরা দেখতে পাই যে বৈচিত্র্য আসলে একটি সমৃদ্ধ এবং স্পন্দনশীল এবং সাধারণত আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজকে সমর্থন করে," তিনি উপসংহারে বলেন।
সম্পাদনা: ডেভিস ভ্যানওপডর্প। তাঁদের এই তথ্যবহুল লেখা পেয়ে আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। পাদটিকাঃ বিষয়গুলি আমেরিকা ও কানাডার বেলায়ও অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু এটি কেবলমাত্র অন্যের লেখার অনুলিখন বিধায়, এখানে বিষয়বস্তু বদল করা গেল না। এ বিষয়ে লেখা অন্য এক কিস্তিতে পরিবেশন করা হবে। শুধু এটুকু জানাতে চাই যে সারা আমেরিকা জুড়ে এখন প্রায় ৩,০০০ মসজিদ আছে।