৭০-এর ওপরে বয়স আমার। রাত ১১টার পর যদি অতিথি শিল্পীকে মঞ্চে ওঠানো হয় তাহলে এত রাত পর্যন্ত আমরা কি সেখানে বসে থাকতে পারি? এরপর নিমিষেই কন্ঠে স্বস্তির সুর টেনে বললেন, তবে এবার দেখলাম দল মত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই এসেছেন অনুষ্ঠানে। সবাইকে কাছে টানার আয়োজকদের এই উদ্যোগটার প্রশংসাও করলেন প্রবীন এই দর্শক। কথাগুলো বলছিলেন মকবুল হোসেন। তিনি কানাডায় আছেন তিন দশক ধরে। প্রবাসে কমিউনিটির বিভক্তি নিয়ে লম্বা-চওড়া এক বক্তব্যও দিলেন এরপর।
কানাডায় জন্ম নেয়া এ প্রজন্মের মেয়ে পারভিন এসেছে মায়ের সাথে দুদিনই। কেমন লাগছে এখানে এসে? উত্তরে তিনি বললেন, আমি খুব খুশি। মা সাতটি শাড়ি, তিনটি লেহেঙ্গা কিনেছে। লেহেঙ্গাগুলো আমার। এখানে এতো বাঙালি আর এতো অনুষ্ঠান আমার ভালোই লাগছে। সে গর্বের সুরে বললো জায়েদ খানের সাথে নৃত্যে অংশ নেয়া ইশিতা চৌধুরী তার বান্ধবী।
দেবাশীষ দেবু সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক। নাক কান গলা (ইএনটি’র ) সার্জন। কিছুদিন হলো কানাডায় এসেছেন সপরিবার। সম্মেলনে এসেছিলেন তিনিও। ডা. দেবাশীষ জানালেন বাংলাদেশকেই যেন খুঁজে পেয়েছেন এখানে এসে। এতো শিল্পী, এতো মানুষের সমাবেশ, এতো কলরব মুগ্ধ করেছে তাঁর স্ত্রী ডা. তুলিকেও।
নজরুল ইসলাম নামে এক দর্শক প্রায় সারাক্ষণই হলের বাইরে একটি শাড়ির স্টলে বসে মালিকের সাথে আড্ডা মারছিলেন। মাঝেমধ্যে হলের ভেতর ঢু মারছিলেন। ভালো লাগছিলো না বারবার মঞ্চে কমিটির লোকজনকে ডেকে নেয়া। তবে বাইরে বসে থাকার কারণে এক ফাঁকে নুসরাত ফারিয়ার জমকালো ড্যান্সটা মিস করেছেন তিনি।এতে বেশ আফসোসও করলেন নজরুল।
মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত ৩৯তম ফোবানার সম্মেলনে আসা লোকদের কাছ থেকে এরকম তাৎক্ষণিক মিশ্র অনুভূতিই পাওয়া গেছে। ফোবানা সম্মেলন শেষ হয়েছে সপ্তাহেরও বেশি আগে।তবে কমিউনিটিতে সম্মেলন নিয়ে কথা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বাসা বাড়ির কিংবা কফি শপের আড্ডায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর সফলতা নিয়ে যেমন কথা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে; হচ্ছে এর ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও।
দেখলাম কার পার্কিং সমস্যা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। ডাউন টাউনের ব্যস্ত এলাকায় ভেন্যু থাকায় ফোবানার আভিজাত্য বাড়লেও দর্শকদের পার্কিংয়ে ভোগান্তি হয়েছে। পার্কিং পেতে সমস্যা, সময় ব্যয় এবং অনুষ্ঠানের টিকেটের সাথে দুদিনের পার্কিং পে’র বোঝা ছিল অনেক দর্শকের অপ্রত্যাশিত ভাবনা। যদিও পুরো সম্মেলন নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত থাকার পরও কনভেনর জিয়াউল হক জিয়া পার্কিং স্পট ও সহজে পার্কিং করার বিষয়ে বারবার ফেসবুকে লাইভ দিয়েছেন।
তবে একটি ভালো দিক, আয়োজক কমিটির কনভেনর জিয়াউল হক জিয়া সকল সমালোচনা হাসিমুখেই গ্রহন করছেন।দর্শকদের এসব মতামত সামনে আনলে তিনি বললেন, দর্শক মতামতকে আমাদের স্বাগত জানানোই উচিত। জানালেন, ফেসবুকের কয়েকটি পোস্টে সম্মেলনের পজেটিভ, নেগেটিভ উভয় মতামতেই সাড়া দিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে তাদেরকে এজন্যে ধন্যবাদও দিয়েছেন তিনি।
ফোবানা মন্ট্রিয়ল ২০২৫’ র অ্যামবাসেডর কানাডার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শামীমুল হাসান দর্শকদের অভিমত, চাওয়া পাওয়ার প্রতি যত্নশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে এটিও বলেন, ফোবানার বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সুচারু ভাবে চালিয়ে নেয়া সহজ নয়। তবে দর্শকদের ফিডব্যাক অনুষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সামাজিক সংগঠক, সংষ্কৃতি অনুরাগী শামীমুল হাসান দীর্ঘদিন থেকে ফোবানার সাথে জড়িত, অনুষ্ঠানেগুলোতে বিশেষ ভাবে সহযোগিতা প্রদানকারী হিসেবেও পরিচিত।
জানা গেছে, ৯ বছর পর ২০২২-এ বাংলাদেশ সোসাইটি অব মন্ট্রিয়ল এখানে ফোবানা এনেছিল। এরপর আর এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। এরপরের বছরই ২০২৩-এ এই নগরে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব মন্ট্রিয়ল নিয়ে আসে ফোবানা। বছর বিরতির পর হোস্ট সংগঠন কানাডা-বাংলাদেশ সলিডারিটি ( সিবিএস )’র আয়োজনে এবছর আবার মন্ট্রিয়ল সরব হয় সম্মেলনে। সফলতার সিঁড়ি বেয়ে চারবছরের মধ্যে তিনটিরই আয়োজক-নগরের মর্যাদা পায় মন্ট্রিয়ল।
এবার ফোবানার ভেন্যুটি ছিল নগরের প্রাণকেন্দ্র ডাউনটাউনের একটি পাঁচতারা হোটেলের কনফারেন্স হলে। ফোবানার প্রথাগত তারিখ ২৯, ৩০, ৩১ আগস্টেই বসেছিল সম্মেলন। আসলে লেবার ডে লংউইকেন্ডটি সম্মেলনে আসা উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিরা উদযাপন করেন এক প্রীতিময় মিলনমেলায়। দুদিনের অনুষ্ঠানেই ছিল বিপুল সংখ্যক দর্শক। হলের বাইরে স্টলগুলোতেও ছিল ভিড়।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।বাংলাদেশ ও কানাডার জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় ও অতিথি মিলিয়ে শতাধিক শিল্পী অংশ নেন। কার নাম বলা হবে, কার না - সব শিল্পীই সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন মিলি ইসলামের কন্ঠে - “জানি বাহিরে আমার তুমি অন্তরে নও, ভাঙ্গিয়ো না এ মধুর ভুল … “ এতো দরদ দিয়ে গাইছিলেন হাততালি থামছিলই না দর্শকদের।নারী মুক্তির ওপর করা অসাধারণ নৃত্যে হলের পরিবেশটাই পাল্টে যায়। নৃত্যশিল্পী জসিম উদ্দিনের কোরিওগ্রাফি, পরিচালনা ও অংশগ্রহণে নৃত্যকণা একাডেমির দলীয় নৃত্যটি বাংলা, বাঙালি আর দেশমাতৃকার কৃষ্টি, লোক ঐতিহ্যকে অপরূপ ভাবে তুলে ধরেছে। বেশ পরিশ্রমী ও নিপুন পরিবেশনা ছিল এটি। অতিথি শিল্পী বিন্দুকণা, স্বীকৃতি, আরজিন, ফোক শিল্পী মম সহ অন্য সবাই গানে গানে দর্শক ধরে রেখেছেন হল জুড়ে।
গীতিকবি কবির বকুলের লেখা শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নীর সাথে সম্মেলনের থিম সংয়ে কন্ঠ মেলান কয়েকজন সহশিল্পী। নাচ, গান, নাটিকা, মুকাভিনয়, আবৃত্তি হয়েছে সন্ধ্যা থেকে একটানা রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে হয়েছে নানা বিষয় ও পর্যায়ে পুরস্কার বিতরণী, এওয়ার্ড প্রদান, সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা, পরিচয় পর্ব।
সময়ের ক্রেজ অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার জমজমাট নৃত্যে কেঁপে ওঠে যেন মঞ্চ। দর্শকদের নাচে, আনন্দ-চিৎকারে আলো ঝলমল হলে তখন প্রবাহিত হয় উত্তাল উচ্ছ্বাসের ঢেউ। দর্শকরা উপভোগ করেন নায়ক জায়েদ খানের পরিবেশনাও। পরিবেশনার মাঝে তার বুদ্ধিদীপ্ত সরল সাবলীল অথচ চঞ্চল ‘অডিয়েন্স-ইন্টারেকশন’ ছিল মঞ্চ মাতানো। নিজের প্রচুর জনপ্রিয় গান থেকে কয়েকটি গেয়ে শোনান শিল্পী তপন চৌধুরী। শেষদিন রাত প্রায় দেড়টায় মঞ্চে উঠেন ব্যান্ড আর্কের হাসান। তার গানের সাথে, নাচের সাথে করতালি আর হাত উঁচিয়ে নাচেন দর্শকরাও।
সম্মেলনের বিশেষ পর্ব সেমিনারটি ছিল উল্লেখ করার মতো। উত্তর আমেরিকা ও বাংলাদেশের একদল একাডেমিক স্কলারকে একত্রিত করেছিলেন সেমিনারের পূর্ণ দায়িত্বে থাকা লেখক, অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সোয়েব সাঈদ। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সাজানো হয়েছিল সেমিনারের প্রতিপাদ্য। বাংলাদেশ, কানাডা, আমেরিকা তথা বিশ্বে চলমান সমস্যা, সংকট, সমাধান, সম্ভাবনা ইত্যাদি সময়োপযোগী ভাবনাগুলো অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপন করেন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য পেশায় খ্যাতিমান ব্যক্তিরা। একটি উন্নতমানের সেমিনার উপহার দিতে এর পরিচালক, সঞ্চালক ও সমন্বয়ক ড. সোয়েব সাঈদকে যে বেশ হোমওয়ার্ক করতে যে হয়েছে তা অনুমেয়।সম্মেলনের অন্যান্য পর্ব যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ট্যালেন্ট শো, বিজনেস লীডারস সামিট, কাব্য জলসা, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট সেমিনার, স্টুডেন্টস স্কলারশীপ ইত্যাদির দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো।
অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন শামসাদ রানা ও লাবলু আকন। সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ সাংস্কৃতিক পর্বের বড় দায়িত্বটির প্রচুর ব্যস্ততা সামলেও শামসাদ রানা উপস্থাপনায় ছিলেন সাবলীল, উজ্জ্বল। উপস্থাপনায় লাবলু আকনের পদচারণাও দীর্ঘদিনের। অল্প কথায় বেশি প্রকাশের কৌশল জানেন লাবলু। চৌকস এই দুই উপস্থাপক দুদিনের পুরো অনুষ্ঠানই চালিয়ে নেন গতিময় করে।
সম্মেলনের প্রথম দিন ছিল গালা ডিনার পার্টি। এরপরের দুদিন ডাউন টাউনের ইভো সেন্টারটি ও এর চারপাশ বাঙালিদের সমাগমে মনে হয়েছিল বাংলাদেশেরই একটি অংশ। এবারের ফোবানায়ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীরা অংশ নেন।
৩১ আগস্ট ৩৯ তম আসরের পর্দা নামার পর মন্ট্রিয়ল থেকে আবার আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় ফোবানা। ফোবানার ৪০ তম আসরটি বসবে ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডো শহরে। এদিকে এক বিবৃতিতে অনুষ্ঠানের দর্শক, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান ফোবানা স্টিয়ারিং কমিটির সদ্যপ্রাক্তন চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান, সম্মেলনের কনভেনর জিয়াউল হক জিয়া, মেম্বার সেক্রেটারি সাংবাদিক ইকবাল কবির ও চীফ কোঅর্ডিনেটর আবুল হোসেন দুলাল।
ফোবানার নতুন কমিটি
ফোবানার ২০২৫-২০২৬ সেশনের এক্সিকিউটিভ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন জাহিদ হোসেন পিন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান সিবিএস’র সভাপতি জিয়াউল হক জিয়া। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি নির্বাচিত হন নেহাল রহিম। ৩৯ তম সম্মেলনের মেম্বার সেক্রেটারি, নির্বাচন কমিশনার ইকবাল কবির জানান, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, এজিএস আমিনুল জিলানী কলিন্স, ট্রেজারার সাইদা হাই ।আউটস্টান্ডিং মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন ইকবাল কবীর, হাফিজুর রহমান, আব্দুল চৌধুরী শাহীন, এম এ অদুদ, আনোয়ার হোসেন (কাজী মশহুরুল হুদা)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেদারুল ইসলাম বাবলা। নির্বাচন কমিশনার ছিলেন কাজী মশহুরুল হুদা ও ইকবাল কবির।
উল্লেখ্য, মন্ট্রিয়ল ছাড়া এবার ফোবানার আরও দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে আমেরিকার আটলান্টা জর্জিয়া ও বাফেলো নায়েগ্রা ফলসে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৭ সালে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যকার ঐক্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি লালন ও প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ফেডারেশন অব বাংলাদেশি এসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা ) যদিও বহুবছর ধরে ঐক্যে নেই। তবু বিভক্ত ফোবানার সম্মেলনের আমেজ এখনও ফুরিয়ে যায়নি।