নিউ ইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটির এক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত অভিভাবক, সমাজকল্যাণে নিবেদিত প্রগতিশীল মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব, একজন খাঁটি দেশপ্রমিক, নিউ ইয়র্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক সংগঠন দি অপটিমিস্টস্-এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং আমার পরম শ্রদ্ধেয় দীক্ষাগুরু ও সহকর্মী অধ্যাপক সারোয়ার বি সালাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই মৃত্যু আমার জন্য গভীর বেদনার ও শোকের।
অধ্যাপক সারোয়ার বি সালাম-এর মৃত্যুতে আমি যে গভীর শোকাহত হয়েছি, সে অনুভূতি প্রকাশ ছাড়াও আমি মনে করি, আমাদের কমিউনিটি, আমাদের সংগঠনসমূহ, এবং আমাদের প্রবাসের অসংখ্য সাধারণ মানুষদের পক্ষ হয়ে প্রয়াত অধ্যাপক সারোয়ার বি সালামের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করাও আমার দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে, সে ভাবনা থেকেই আমার এ লেখার অবতারণা।
সম্ভবত আঠানব্বই বা নিরানব্বই সালে সালাম ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা তার ব্রুকলিনস্থ অফিসে। তৎকালীন নিউ ইয়র্কের অন্যতম এক বাংলা সংবাদপত্রিকা সাপ্তাহিক নতুন প্রবাসীর সম্পাদক শিকদার হুমায়ুন কবীর-এর সঙ্গী হয়ে পরিচিত হয়েছিলাম সালাম ভাইয়ের সাথে। অল্পক্ষণের আলাপচারিতায় পরিচয় পেয়েছিলাম একজন অকটপ সত্যভাষী, বিদ্যানুরাগী, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং প্রবাসের গণমাধ্যমসমূহের নিঃস্বার্থ পৃষ্ঠপোষকের। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার আগে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক। নিউ ইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটিকে গড়ে তোলার পিছনে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিলো। তিনি ছিলেন প্রকৃত একজন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ। পুজা সমিতি থেকে মসজিদ কমিটি পর্যন্ত সর্বত্র তিনি ছিলেন সকল বিতর্কের উর্ধে সর্বজনস্বীকৃত অবিসংবাদিত নেতা। যে কোনো দুর্দিনে বিপদে আপদে তার শরণাপন্ন হয়ে সন্তোষজনক সমাধান না নিয়ে তার কাছ থেকে কেউই ফিরে যাননি। দেশে কিংবা বিদেশে, দুর্দশাগ্রস্থ সকল মানুষের জন্য তার হাত সব সময় ছিল উদার। সারোয়ার বি সালাম যেমন ছিলেন একজন কবিতা প্রেমিক, তেমনি ছিলেন একজন কবি। তার রয়েছে একাধিক প্রকাশিত কবিতার বই।
আমাদের সংগঠন অপটিমিস্টস্-এর জন্য সালাম ভাই ছিলেন একজন অনেক বড় উৎসাহ-উদ্দীপনাদাতা। অপটিমিস্টস্-এর হয়ে তিনি সস্ত্রীক বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন এটা নিশ্চিত করতে যে, প্রবাসী মানুষদের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে আমরা যে অর্থ সংগ্রহ করছি, সেটা যেন বাংলাদেশের প্রকৃত অসহায় দরিদ্র পরিাবরের শিশুদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি অপটিমিস্টস্-এর সাফল্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, অপটিমিস্টস্-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোহাম্মদ চৌধুরী রানাভাই ও অপর সহ প্রতিষ্ঠাতা শামীম আহমদসহ আমি যখন তাকে অপটিমিস্টস্-এর উপদেষ্টা থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করি, তখন তিনি সম্ভবত আমাদের এই যুক্তিতেই রাজি হয়েছিলেন যে, তিনি যদি এই পদটি গ্রহণ করেন, তাহলে অপটিমিস্টস্-এর কার্যক্রম প্রবাসে এবং দেশে আরো বেশি বিস্তৃত হবে, এবং এতে বাংলাদেশের অধিকসংখ্যক অসহায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উপকার হবে। অপটিমিস্টস্-এর হয়ে বাংলাদেশের শিশুদের সাহায্যার্থে যে কোনো মানুষের কাছে অর্থ সাহায্য চাইতে তিনি কখনও কুণ্ঠিত বোধ করেননি।
যদিও শুরুর দিকে অপটিমিস্টস্-এর সাথে অধ্যাপক সারোয়ার বি সালামের প্রাথমিক সম্পর্ক ছিল একজন পেশাদার আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে, কিন্তু কখনই তিনি তার পেশাগত কাজের জন্য অপটিমিস্টস থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেননি, বরং তিনি শুরু থেকেই অপটিমিস্টস্-এর শিশু স্পন্সরশিপ প্রকল্পের একাধিক শিশু স্পন্সর করেছেন। এছাড়াও অপটিমিস্টস্-এর বিভিন্ন সাংগঠনিক ব্যয় নির্বাহে তিনি নিয়মিত আর্থিক সহায়তাও দিয়ে গেছেন।
আমি বিশ্বাস করি, প্রবাসী বাংলাদেশি সকল সংগঠনের মধ্যে অপটিমিস্টস্-কে একটি গুরুত্বপূর্ণ, ব্যতিক্রমী ও কার্যকর জনকল্যাণমুখী সংগঠনে পরিণত করার জন্য সারোয়ার বি সালাম-এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অপটিমিস্টস্ যতদিন সক্রিয় থাকবে, ততদিন অপটিমিস্টস্-কে অধ্যাপক সারোয়ার বি সালামের এই অপরিশোধ্য ঋণের কথা স্বীকার করতেই হবে।
পরম শ্রদ্ধেয় সালাম ভাইয়ের অন্তিম যাত্রায় কামনা করছি, সালাম ভাই যেখানেই থাকেন, যেভাবেই থাকেন, আমার মতো হাজার হাজার মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা অবশ্যই তার সাথে থাকবে। একই সাথে আমরা আশা করছি, আমরা সালাম ভাইয়ের মঙ্গলভাবনা এবং আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়ে, তারই দেখানো আলোকিত পথ ধরে যেন সকল লোভ-লালসা আর ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থেকে নীতি, আদর্শ, সততা ও কল্যাণমনস্কতায় অবিচলভাবে মানব সেবার লক্ষ্যে কাজ করে যাবো।
( লেখক সেবামূলক সংগঠন দি অপটিমিস্টস্-এর চেয়ারম্যান)