নিউইয়র্কের ওজনপার্কে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশী যুবক উইন রোজারিও অন্তেষ্টিক্রিয়া শনিবার (৬ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য সকল প্রস্তুতি চলছে। এদিকে সোমবার (১ এপ্রিল) তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতোদিন তার মরদেহ জ্যামাইকা হাসপাতালের মর্গে ছিলো। রোববার এসব কথা জানিয়ে উইনের বাবা ফ্রান্সিস রোজারিও বলেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
এদিকে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশী যুবক উইন রোজারিওর বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা। তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে পুলিশের দোষ প্রমাণ হলে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি।
জ্যাকসন হাইটসে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
অপরদিকে পুলিশের গুলিতে উইন রোজারিও হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে নিউইয়র্কে। গত ২৯ মার্চ শুক্রবার বিকেলে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় এ কর্মসূচির আয়োজন করে। প্রবাসী বাংলাদেশী খ্রিস্টান এসোসিয়েশন ও লাল মরিচ নামে দুটি সংগঠন আলাদাভাবে এ সমাবেশের আয়োজন করে। এসোসিয়েশনের সভাপতি গাব্রিয়েল তাপস হোমেজ এর সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশে এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি সহ ৪ দফা দাবী উপস্থাপন করা হয়েছে।
সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, মানসিক অসুস্থ একজন তরুণের প্রতি সংবেদনশীলতা না দেখিয়ে তাকে মায়ের সামনে গুলি করে হত্যা করে নিউইয়র্ক পুলিশ অমানবিক ও নিষ্টুরতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানবাধিকারের তীর্থভূমি যুক্তরাষ্ট্রে এ ঘটনা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সমাবেশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছাড়াও বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী কমিউনিটির লোকজন অংশ নেন। সমাবেশ থেকে ঘটনার সময়ে রেকর্ডকৃত পুলিশের বডিক্যাম ফুটেজ প্রকাশ করার দাবী জানানো হয়। এছাড়া ন্যাক্কারজক এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত ও তাদেরকে ফৌজদারী আইনের আওতায় এতে বিচারেরও দাবী জানানো হয়। এ ঘটনায় ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও নিউইয়র্ক মেয়র এরিক এডামস কোন বক্তব্য বা নূন্যতম সহানুভূতি প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা। এসময় প্রবাসী বাংলাদেশী খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লুথারেন চার্চের প্যাস্টর জেমস রয়, জোসেফ বিকাশ ডি কস্তা, চিত্তা রোজারিও, জেমস কুরাইয়া, ‘স্যাফেস্ট’র প্রধান নির্বাহী মাজেদা এ উদ্দিন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট এএফএম মিসবাহুজ্জামান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট সুখেন গোমেজ।
প্রবাসী বাঙালী খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বকারীরা। ছিলেন পেশাজীবী এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীরাও। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রচন্ড ক্ষোভ দেখায় এই সমাবেশ থেকে।
সমাবেশে ডেমোক্রেটিক পার্টির কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাট লার্জ এটর্নি মঈন চৌধুরী জানান, উইন রোজারিওর পরিবার এই হত্যাকান্ডে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালানোর জন্য তার সহযোগী ফার্মকে নিযুক্ত করেছেন। ইতিমধ্যেই তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বডি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। সবকিছু তাদের ফার্মের বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখবেন।
এটর্নি মঈন চৌধুরী জানান, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উইন রোজারিওর হত্যার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছেন নিউইয়র্ক স্টেট এটর্নি জেনারেল। পাশাপাশি আমাদের ফার্মও তদন্তে নেমেছে। ন্যায়বিচারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়ে যাবো।
এদিকে সোমবার (১ এপ্রিল) বিকালে নিউইয়র্কে একইস্থানে উআন রোজারিও হত্যার বিচার দাবীতে বিক্ষোভ প্রদর্শণ করে আঞ্চলিক সংগঠন গাজীপুর জেলা এসোসিয়েশন ইউএসএ।
ওজোন পার্কে পুলিশের গুলিতে যেভাবে নিহত হলো উইন রোজারিও
নিউইয়র্ক ভিত্তিক বার্তা সংস্থা ইউএনএ জানয়: বাংলাদেশী অধ্যুষিত নিউইয়র্কের ওজোন পার্কে পুলিশের গুলিতে এক বাংলাদেশী তরুণ নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম উইন রোজারিও (১৯)। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলো। পরিবারের অভিযোগ পুলিশ ঠান্ডা মাথায় তাকে হত্যা করেছে। তাদের দেশের বাড়ী গাজীপুর জেলায়। ঘটনাটি বুধবার (২৭ মার্চ) দপুরের। খবরটি নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হওয়ায় ‘টক অব দ্য টাউন’ খবরে পরিণত হয়। উইন রোজারিও-কে নিয়ে গেল দুই মাসে নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হলো।
জানা গেছে, মানসিক রোগে আক্রান্ত উইন বুধবার সকাল থেকে বাসায় উশৃঙ্খল আচরণ করছিলেন। মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করছে ও মৃত্যু কামনা করছে এমনটা জানিয়ে উইন রোজারিও নিজেই তার বাসা থেকে ৯১১-এ কল করেন। ফোন পেয়ে এনওয়াইপিডি’র পুলিশ সদস্যরা দ্রুত দুপুর দেড়টার দিকে তার বাসায় যায়। এসময় পুলিশ তাকে আটকের চেষ্টা করলে উইন ওয়াড্রুভ থেকে কাচি (সিজার) নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণের জন্য উদ্যত হয়। এসময় পুলিশ তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং উদ্ভুত পরিস্থিতে তার মায়ের সামনেই ওই তরুণকে লক্ষ্য করে পরপর ৬ রাউন্ড গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তাকে জামাইকা হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর এনওয়াইপিডি’র পক্ষ থেকে প্রেস বিফ্রিং-এ বিস্তারিত জানায়। পুলিশের দাবি, উইন রোজারিও কাঁচি নিয়ে তাদের মারতে উদ্যত হয়েছিল। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তদন্তের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
নিহত উইন রোজারিওর পিতা ফ্রান্সিস রোজারিও দাবী করেছেন তার ছেলে সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলো। ছেলের মানসিক সমস্যা আছে বলার পরও পুলিশ তাদের কথা শুনেনি। পুলিশ ঠান্ডা মাথায় তার ছেলেকে খুন করেছে অভিযোগ করে তিনি এ ঘটনার ন্যায়বিচার দাবী করেছেন।
জানা গেছে, নিহতের দেশের বাড়ী গাজীপুরের পূবাইলের হারবাইদ গ্রামে। ফ্রান্সিস রোজারিও ২০১৪ সালে পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এরপর থেকে তিনি স্ত্রী আর দুই পুত্র নিয়ে কুইন্সের ওজোনপার্ক এলাকার ১০১-১২ ১০৩ স্ট্রিট ঠিকানার একটি বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। তিনি এবং তার স্ত্রী ইভা কস্তা জন এফ কেনেডি অঅন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত ছিলেন। নিহত উইন রোজারিও নিউইয়র্কের জন অ্যাডামস হাই স্কুল থেকে স্নাতক পাশ করে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরীক্ষায়ও পাশ করেন। তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এ অবস্থায় মানসিক অবসন্নতায় ভুগছিলেন উইন। এদিকে, পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশী তরুণের নিহতের ঘটনায় কমিউনিটিতে শোক ও ক্ষোভের ছায়া নেমে এসেছে। দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
বাংলাদেশের সোসাইটির তীব্র নিন্দা
বাংলাদেশ সোসাইটি’র এক প্রেস বিজ্ঞপ্ততে বলা হয়েছে: নিউইয়র্ক সময় ২৭ মার্চ ১:৪০ মিনিটের দিকে ওজোনপার্ক ১০৩ স্ট্রিট, ১০১ এভিনিউ’র নিজ বাসায় মা আর ছোট ভাইয়ের সামনেই নিউইয়র্ক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারলো মানসিক ভারসাম্যহীন বাংলাদেশী তরুণ উইন রোজারিও। তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ গোটা কমিউনিটি। বাংলাদেশ সোসাইটি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে। একই সাথে ঘটনার সুষ্ঠ সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছে। ঘটনার খবর শোনার সাথে সাথে সোসাইটির কর্মকর্তারা নিহতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
এদিকে কমিউনিটির অন্যান্য সংগঠনকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি এই ঘটনার প্রতিবাদে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।