নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো সিটিতে দুর্বৃত্তের বন্দুকের গুলিতে দুই বাংলাদেশির সন্দেভাজন হত্যাকারীকে গ্রেফতার করেছে বাফেলো পুলিশ। গত ২৯ এপ্রিল বিকেলে বাফেলো সিটি কোর্টে তাকে হাজির করা হয়। স্থায়ী ঠিকানাহীন ৩১ বছর বয়সী ডেল ও’ কিউমিংসের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাকান্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। শুনানির পর আগামী ৩ মে পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও দেখে গত ২৮ এপ্রিল বিকালে ঘাতক যুবককে গ্রেফতারের কথা জানানো হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে ঘাতকের বিষয়ে তথ্য প্রদানকারীকে সাড়ে ৭ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে বাফেলো পুলিশ।
গত ২৭ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১২টায় বাফেলোর জিনার স্ট্রিটে (ইস্ট ফেরি স্ট্রিট ও বেইলি অ্যাভিনিউ কর্নারে) এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ (৫৮) এবং কুমিল্লার বাবুল মিয়া (৪৩)।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মালিকানাধীন এক ব্যক্তির বাড়ি সংস্কারে আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ ও বাবুল মিয়া কাজ করতে যান। বাড়ির দরজা খোলামাত্র, বাড়িটির অভ্যন্তরে অবৈধভাবে অবস্থানরত ভবঘুরে যুবক কিউমিংস, তাদের ওপর আচমকা বন্দুকের গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই একজন এবং গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে অন্যজন মারা যান। ঘটনার পরপরই কিউমিংসে দ্রুত পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়।
জানা গেছে, আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ দুই এবং বাবুল মিয়া সাত সন্তানের জনক। তারা দু’জনই অল্প কিছুদিন আগে মেরিল্যান্ড থেকে বাফেলোতে এসে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন।
বাবুল মিয়া আগে সপরিবারে থাকতেন ম্যারিল্যান্ডে। সম্প্রতি তিনি বাফেলোতে চলে আসেন। আর ইউসুফ গত ডিসেম্বরে স্ত্রী এবং দুই মেয়েসহ বাফেলোতে আসেন।
এমন মর্মান্তিক ঘটনায় কানাডা সীমান্ত সংলগ্ন বাফেলোতে বসবাসরত অর্ধ লক্ষাধিক প্রবাসীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
ঘটনার পরপর বাফেলো পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে সিটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিম পুরো এলাকা ঘেরাও করে রাখে। এদিকে কমিউনিটির নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় নেই বলে দাবি করা হয়েছে।
এদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র বায়রন ব্রাউন গুলির ঘটনাকে ‘নৃশংস’ এবং এটিকে ‘ ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকান্ড’ বলে অভিহিত করেন। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তিনি গভীর দুঃখপ্রকাশের পাশাপাশি বাফেলোর বাংলাদেশি কমিউনিটির পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জে কিন বলেন, ড্যাল ও’ কিউমিংসের বিরুদ্ধে বাফেলো ক্রিমিনাল কোর্টে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। তিনি গৃহহীন, ভবঘুরে। তার নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা না থাকায় মামলাগুলোর একটিতেও হাজিরা দেননি। হত্যাকাণ্ডের প্রায় একই সময়ে ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভি ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তির কাছ থেকে একটি অটোমেটিক রাইফেল জব্দের কথা জানিয়ে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি বলেন, অস্ত্রটি বেআইনিভাবে তার দখলে ছিল। দুই বাংলাদেশিকে হত্যায় সেটি ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
বেআইনি অস্ত্র বহনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ড্যাল ও’ কিউমিংসের সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে জানিয়ে জে কিন বলেন, আর জোড়া খুনের ঘটনার দোষী সাব্যস্ত হলে আজীবন তাকে কারাগারে থাকতে হতে পারে।
এদিকে দুই বাংলাদেশিকে হত্যার প্রতিবাদে গত ২৮ এপ্রিল জোহরের নামাজের পর বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো মানুষ বাফেলো মুসলিম সেন্টারে জড়ো হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ প্রবাসীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। হত্যাকারীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
নিহত দু’জনের পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে অনেক বাংলাদেশি তাদের প্রতি অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। পরিবার দু’টি যেনো সংকট কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, সেজন্য বাফেলো কমিউনিটির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়।
নিউইয়র্কের সিকিউরিটি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিয়া এম মোর্শেদ পরিবার দুটিকে সহযোগিতার জন্য বাফেলো যাচ্ছেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে বাংলাদেশ মুসলিম সেন্টার অব বাফেলোর সভাপতি একেএম ফাহিম, আল ইসান জামে মসজিদের সভাপতি ও বৃহত্তর কুমিল্লা সোসাইটির সভাপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী আবুল বাসার, বিএনপি নেতা মতিউর রহমান লিটু, বাফেলো সিটি হলের কর্মচারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার মো. সিরাজুল মোস্তফা (জাভেদ), বাফেলো বিএনপির নেতা ইমতিয়াজ বেলাল, বরিশাল সোসাইটি অফ বাফেলোর সভাপতি সৈয়দ ঝিলু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামান মিয়া, বায়তুল মোকাররম মসজিদের সভাপতি কবির পোদ্দার, হোম ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামাল হোসেন, ড. ফাহিম তাজওয়া, ড. মোমিন উল্লাহ, মইনুল হোসেন, আব্দুল মান্নান তাজু, মারুফ আহাম্মেদ, ফাইজুর রহমান, জামাল উদ্দিন, বোরহান আলী ও খালেদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ইউসুফ ও বাবুল হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত প্রবাসীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন বাফেলোর বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতারা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাফেলো সিটি মেয়র বাইরেন ডাব্লিউ ব্রাউন, বাফেলো পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্রেমাগলিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা কমিউনিটির সংকটে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছিলেন। একই সাথে দুর্বৃত্তকে শনাক্ত ও গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টার বিষয়টি অবহিত করেন তিনি। তবে শেষের দিকে প্রবাসীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখ বাফেলো সিটি মেয়র বাইরেন ডাব্লিউ ব্রাউন এবং পুলিশ কমিশনার জোসেফ গোমালিয়া ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বিক্ষোভ সমাবেশের ঘণ্টা দুয়েক পর সিটির ইস্ট ডেলাভান এবং নর্থ ফর্ক এলাকা থেকে সন্দেহভাজন ওই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত ২৯ এপ্রিল বাফেলোর পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্র্যাগম্যাগলিয়া বলেন, বাড়ির অসংখ্য আলামত পুলিশকে তাদের তদন্তে এবং কিউমিংসকে শনাক্ত করতে সহায়তা করেছে। পুলিশের মতে, বাড়িতে পাওয়া একটি কোণার দোকান থেকে একটি রসিদ তাদের পরিষ্কার নজরদারি চিত্র খুঁজে পেতে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছিল।
গ্র্যাগম্যাগলিয়া বলেন, কিউমিংসের কাছে একটি ৯ মিমি লম্বা রাইফেল ছিল, যা অর্ধেক ভেঙে একটি ব্যাগে সহজেই লুকানো যায়।
এদিকে গত ২৯ এপ্রিল এক প্রেস কনফারেন্সে এরি কাউন্টি জেলা অ্যাটর্নি মাইকেল কীন বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনও চলমান।
জোড়া খুনের সংবাদ জানার পরপরই নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল মো. নাজমুল হুদা নিহতদের স্বজন এবং বাফেলো কমিউনিটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
স্টপ দ্য ভায়োলেন্স কোয়ালিশনের নির্বাহী পরিচালক মারে হলম্যান জানান, আমাদের এই বাফেলো শহর খুব শান্ত ছিল। যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন এটি খুব দুঃখজনক। সহিংসতাবিরোধী সম্প্রদায়ের অন্য সদস্যরা তাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন বলে তিনি আশা করেন।
এদিকে নিহত বাবুল মিয়ার পাঁচ মাসের অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রীর আহাজারিতে বাফেলো শহরের আকাশ-বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে। অভিবাসন নিয়ে বছর খানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন নুসরাত জাহান। স্বামীকে হারিয়ে তিনি এখন দিশেহারা। এই পৃথিবীতে নিকটাত্মীয় বলে তার আর কেউ রইল না। কিভাবে সন্তানকে মানুষ করবেন তিনি? গর্ভের সন্তানের ভবিষ্যত-ই বা কী হবে?
বাবুল মিয়ার স্ত্রী নুসরাত জাহান বলেন, আজকে আমি এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। আমার স্বামীকে যে বা যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
থমথমে পরিবেশ গুলিতে নিহত অপর বাংলাদেশি আবু সালেহ ইউসুফের বাড়িতেও। মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশিদের সঙ্গে থাকবেন বলে মাত্র সাত মাস আগে ইউসুফও এসেছিলেন বাফেলোতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হতে হলো তাকে। ইউসুফের স্ত্রী এখন সন্তানদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র যেন দিনদিন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে অভিবাসীদের জন্য।
নিহত আবু সালে ইউসুফের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামী কোনো অপরাধ করেনি। যারা আমার সন্তানদের এতিম করলো, আমি তাদের বিচার চাই। আমেরিকান সরকারের কাছে আমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই।
দেশে শোকের মাতম : বাবুল মিয়ার মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশে তাঁর গ্রামের বাড়িতে পড়ে যায় কান্নার রোল। স্বজনরা জানায়, বাবুল মিয়া এক বছর আগে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাফেলোতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান।
অন্যদিকে ইউসুফের মৃত্যুর খবর তাঁর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে সেখানেও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
নিহতের চাচা ফয়েজ উদ্দিন বলেন, ‘ইউসুফকে গুলি করে হত্যার খবর আমরা প্রথমে পাই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কানাইঘাটের দুলাল আহমদের কাছ থেকে। এরপর থেকেই ইউসুফের মা-বাবা আহাজারি করছেন। ইউসুফের মা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন।’ ফয়েজ উদ্দিন জানান, সিলেট নগরের মোবাইল মার্কেটখ্যাত করিমউল্লাহ মার্কেটে ইউসুফের মোবাইল ফোনসেটের শোরুম ছিল। পারিবারিক আবেদনের সূত্রে ভিসা পেয়ে দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পেইন্টারের কাজ নেন তিনি। বাবুলের সঙ্গে বাড়িতে রঙের কাজ করার সময়ই দৃর্বুত্তরা তাঁদের গুলি করে।
এদিকে গত ৩০ এপ্রিল বাদ জোহর বাফেলো মুসলিম সেন্টারে বাবুল মিয়ার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে তাকে স্থানীয় স্টোন স্ট্রিট কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফের মরদেহ মেরিল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বুধবার তার জানাজা ও দাফন হওয়ার কথা রয়েছে।