নিউ জার্সি অ্যাঙ্গেলউড -সবুজ-ঘেরা, শান্তিপূর্ণ এক এলাকা, যা বার্গেন কাউন্টিতে অবস্থিত ও নিউইয়র্ক সিটির খুব কাছেই। তাই শহুরে ছোঁয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেছে এলাকাটি। শনিবার (১৭ মে) এখানেই হয়ে গেল ছোট পরিসরে ‘পিজ্জা অ্যান্ড পোয়েট্ট্রি’ আড্ডা; কবি লেখক কুলসুম আক্তার সুমীর বাড়িতে। আড্ডায় অংশ নেন কবি সুমন শামসুদ্দীন ও তার স্ত্রী, কবি শরিফুজ্জামান পল ও তার পরিবার, গল্পকার লেখক সোহানা নাজনীন ও তার পরিবার এবং কবি এইচবি রিতা। সারপ্রাইজ দিতে যুক্ত হন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা'র সম্পাদক সাংবাদিক ইব্রাহীম চৌধুরী ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, প্যাটারসন শহরের স্কুল বোর্ডের কমিশনার মোহাম্মদ রাশিদ।
কবি ও লেখকরা আলোচনা করেন কবিতায় ছন্দ, অক্ষর-মাত্রা গণনা, পর্ব, ধ্বনি, কবিতার ছন্দ, গতি ও উচ্চারণশৈলীর ক্ষেত্রে শ্বাসঘাতের সঠিক ব্যবহার, ছন্দে মুক্তাক্ষর-বদ্ধাক্ষরের ব্যবহার ও কবিতায় মনস্ত্ত্ত্ব নিয়ে। একটি পঙ্ক্তি কীভাবে তার ছন্দ ও শ্বাসঘাতের মাধ্যমে অন্যরকম একটি আবহ তৈরি করতে পারে বা মাত্রার সামান্য পরিবর্তন কীভাবে একটি কবিতার গতি ও মেজাজ বদলে দিতে পারে ইত্যাদি বিষয়গুলো তোলে ধরেন কবি সুমন শামসুদ্দীন।
তিনি কবিতায় স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ‘অক্ষর’-এর তাৎপর্য তুলে ধরেন।
সুমন শামসুদ্দিন বলেন, ‘সাধারণভাবে, অক্ষর মানে হল ভাষার লেখ্য রূপের একক যেমন: ক, খ, গ, চ ইত্যাদি। তবে ছন্দশাস্ত্রে, ‘অক্ষর’ বলতে বোঝানো হয় ধ্বনির একক, যা কবিতায় ছন্দ গঠনের ভিত্তি। তবে এই ‘অক্ষর’ সব ছন্দে সমভাবে ব্যবহৃত হয় না।’ এরপর তিনি আরো বিশদ ব্যাখ্যা করেন।
কবিতায় মনস্তত্ত্বের আবোহ বা প্রয়োগের উদাহরণস্বরূপ কবি এইচবি রিতা উপস্থাপন করেন তার লেখা কবিতা ‘মা, তুমিই পৃথিবীর প্রথম আলোটা।’ আবৃত্তি করেন সুমন শামসুদ্দীন। কবিতাটি পাঠ করার সময় আবৃত্তিকারের চোখ ভিজে উঠে, চারপাশে সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
এইচবি রিতা বলেন, ‘মা, তুমিই পৃথিবীর প্রথম আলোটা’- এই পঙক্তির মধ্যে যে মানসিক সংযোগ, যে অনুভূতির আকুতি- তা শুধু শোনার নয়, অনুভব করার বিষয়। এটাই মনস্তত্ত্বের গভীর আবহ -একজন সন্তানের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক, মায়ার ছায়া, স্মৃতির আলোছায়া, অনির্বচনীয় ভালোবাসা - যেখানে সবকিছু মিলেমিশে যায়। আর এই যে কবিতাটি অনেকের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, চোখে জল এনেছে- সেটাই মনস্তত্ত্বের প্রকৃত সফলতা।’
সোহানা নাজনীন জানান, পিজ্জা অ্যন্ড পোয়েট্ট্রি'র যাত্রা শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, বেসাইডের টেরেস শপিং সেন্টারের ‘রোযা পিজ্জা’ রেস্তোঁরায়। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমরা অনেকগুলো লেখকের বই নিয়ে বসেছিলাম। কবিতা পাঠের সাথে আলোচনা হয় বিভিন্ন লেখকের লেখার শৈলী নিয়ে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজের মতো করে কিছু শেখা ও জানা। সেই থেকেই আমরা এই আড্ডা নিয়মিত করছি।’
শরিফুজ্জামান পল বলেন, ‘সাহিত্য তো কেবল পঠন-পাঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি বোঝা, অনুভব করা এবং অন্যের সঙ্গে শেয়ার করার একটি আনন্দময় ও গভীর মানসিক অনুশীলন। সেই ভাবনাকে সামনে রেখেই ‘পিজ্জা অ্যান্ড পোয়েট্ট্রি’র প্রতিটি পর্বে আমরা শুধু কবিতা পাঠ করি না, আমরা কবিতার নেপথ্যের মনস্তত্ত্ব, ছন্দের গঠন, উচ্চারণশৈলী, আবেগ ও ভাবনার গভীরতা নিয়ে নিজেদের মতামত বিনিময় করি।’
কুলসুম আক্তার সুমী জানান, ইব্রাহীম ভাই ও রাশিদ ভাই যখন হঠাৎ যোগ দিলেন, আমাদের আলোচনা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। তাঁদের অভিজ্ঞতা আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ আমাদের আলোচনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
আড্ডার সাথে চলে ভোজনপর্ব। কুলসুম আক্তার সুমী তার হাতের জাদুতে পরিবেশন করেন নানা স্বাদের পদ- বিভিন্ন রকমের ভর্তা, সুস্বাদু মাছ, মজাদার মাংস, ঘন ডাল ও আরও অনেক কিছু। পরিপাটি সাজানো টেবিলে খাবারের রঙ, গন্ধ আর স্বাদ যেন আড্ডার আনন্দকে দ্বিগুণ করে তোলে। পুরো আয়োজনে সহযোগীতা করেন সাফায়েত মজুমদার ও তার কন্যা নবনীতা দ্বিমিত্রা।
ইব্রাহীম চৌধুরী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘কবিতা, পেট আর পল্লবিত পুষ্পের আড্ডা। উত্তর আমেরিকার বসন্তকাল। পল্লবিত পুষ্প, সবুজের ক্লান্তিহীনতা, ছড়িয়ে পড়া পাতার পাতায় কবিতার গন্ধ।’
হাডসন নদী পার হলেই দেখা মেলে এক ঝুলবারান্দা- নিউ জার্সির ইংগেলউড শহরে শাফায়াত-সুমি দম্পতির ঝুলবারান্দা। ভালোবাসার উদারতা যেখানে নিত্য প্রবহমান। সন্ধ্যার রঙ গাঢ় হতেই সেখানে বসছে কবিদের আড্ডা। নিয়ম মেনেই দুয়েকজন অকবিও থাকতে হয় - যাঁদের ঝুলিতে কবিতা নেই, তবে বেল্টের নিচে থাকে বিশাল কাব্যিক পেট, যেন নিজেরাই এক পদ্যরচনার উপকরণ। কবিতা কম বুঝি, কিন্তু ভর্তার বর্ণনা দিতে হলে হেমিংওয়ে হাতড়াতেও রাজী আছি। কবিতা না উদরপূর্তি - আসরের মূলে ছিল, তা বলা মুস্কিল। তরমুজের মতো টানটান চেহারার মাশকালাই ডাল। পিঁয়াজ আর সরিষার তেলে ভাজা বেগুন ভর্তা- কবিতার চরণ ধরে দাঁড়িয়ে, যেন চচ্চড়ির ছন্দে সেজে আসা গৃহিণীর গদ্য। ভর্তা, সুটকি - কামড় বসালেই মনে হচ্ছিল, পেঠুক জীবন আসলেই কবিতার এক জ্বলন্ত উপমা। ‘ভর্তার গন্ধে কতো প্রেমিক ভুলে গেছে প্রেমিকার শরীরের গন্ধ। প্রেমের সংলাপ ভুলে বলে উঠেছে- আজ শুধু ভোজনেই হোক আত্মার উত্থান।’
এমন বসন্ত সন্ধ্যায়, ঝুল বারান্দায়, কবিতা আর কৌতুকের ফাঁকে পেট ফুলে উঠে, কবিতা ঢলে পড়ে। কে কাকে জানাবে - কবিতা যদি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, ভর্তা কিন্তু পেট ছোঁয়। আর এই ছোঁয়াতেই বসন্ত যেন প্রকৃত পূর্ণতা পায়।’
আড্ডায়-নিজ কণ্ঠে নিজের লেখা গান শোনান শরিফুজ্জামান পল। মুহাম্মদ রাশিদ দোলে দোলে কণ্ঠ মিলান ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়ে আমি গেলাম’ গানে। এরপর একটি কবিতা পাঠ করেন তিনি। নানা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ‘পিজ্জা অ্যান্ড পোয়েট্ট্রি’ আড্ডা জমিয়ে তোলেন সবার প্রিয় মিলু ভাই।
আড্ডায় আরো এক আকর্ষণ ছিল শরিফুজ্জামান পলের ছোট শিশুকন্যা সাফরিন আসফিয়া, সোহানা নাজনীনের কন্যা জুনেরা রহমান ও এইচবি রিতার পোষা বিড়াল লোকি। লোকিকে নিয়ে সময় কাটায় জুনেরা ও সাফরিন।
সোহানা নাজনীন বলেন, ‘বড়দের দীর্ঘ আড্ডায় অনেক সময় শিশুরা একা অনুভব করে। কারণ তাদের বিনোদনে সঙ্গী থাকে না। অনেক সময় তারা আর বড়দের সাথে কোথাও যেতে চায় না। তবে রিতার বিড়াল লোকি যুক্ত হওয়ায় বাচ্চারা সুন্দর আনন্দঘন সময় উপভোগ করেছে।’
তাছাড়া, খাওয়া পর্বের পর একসময় আমার ছেলে নোহানকে দেখা যায় তার পড়াশোনা নিয়ে আলাপ করছে এইচবি রিতার সাথে। সুমীর মেয়ে নবনিতাও সময় দিয়েছে জুনেরাকে। মূলকথা, আমাদের দীর্ঘ সময়ের আড্ডায় আমাদের বাচ্চারা যুক্ত হয়ে নিজের মতো করে সময়টুকু উপভোগ করেছে, এটা অনেক কিছু।’
সবশেষে সুমন শামসুদ্দীন জানান, ‘পিজ্জা অ্যান্ড পোয়েট্ট্রি’ আজ হয়তো সাহিত্যচর্চার ছোট্ট একটা মিলনমেলা, তবে ধীরে ধীরে এটি হয়ে উঠছে এক ধরনের বৌদ্ধিক বন্ধুত্বের জায়গা, যেখানে স্বাদ, শব্দ ও ভাবনা- সবকিছু মিলেমিশে তৈরি হয় এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।’
আগামী মাসে এ আড্ডা পিজ্জা রেস্তোঁরায় হবে বলে জানান এইচবি রিতা। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, এই আড্ডা চলতে থাকুক, নতুন মুখ আসুক, পুরনো মুখগুলো ফিরে ফিরে আসুক, আর পঙ্ক্তির ফাঁকে, পিজ্জার গন্ধে, শব্দের জোগান দিয়ে আমাদের আত্মা হোক আরেকটু সমৃদ্ধ।’
আড্ডার শেষে কবি কুলসুম আক্তার সুমীর হাজবেন্ড সাফায়েত মজুমদার ভাই অতিথিদেরকে ধন্যবাদ জানান।