বাঁচাতে হবে হাওরের জীবন ও সংস্কৃতিকে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:১৪


শ্রাবণ-ভাদ্রের হাওরে তখন কূল নেই। দূর দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত জলরাশি, তীব্র ঢেউ। হাওরের সেই ভয়ংকর ঢেউয়ের নাম—‘আফাল’। বর্ষায় ঘন ঘন হয় এই আফাল। পাহাড়সম ঢেউ সবকিছু তছনছ করে দেয়। নৌকা, মাঝি, গাছ—যা পায় গিলে খায় এই জলদৈত্য।
ডিঙি কিংবা বড় নৌকার মাঝিরা টের পেয়ে যায় কখন আফাল আসছে। আকাশের রঙ-রূপ দেখে তারা বুঝে নেয় হাওরের জলের খবর। আফাল আসলে ছোটখাটো সমুদ্রের সাইক্লোনের মতো লাগে। বর্ষাকালে মোহনগঞ্জ থেকে ডিঙাপোতা হাওর হয়ে সুনামগঞ্জের পথে গেলে আফালের দেখা মিলবেই। মাঝি বুঝে ফেললে দ্রুত নৌকা ভিড়িয়ে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। জীবন বেঁচে যায়। কিন্তু মাঝি ভুল করলে আফালের জলে তলিয়ে যায়, ফিরে আসে না আর। প্রতি বছর এমন অসংখ্য প্রাণ আফালের জলে বিলীন হয়।
হাওরের পথে চলে অগণিত মালবাহী নৌকা। নারায়ণগঞ্জ থেকে ইট-সিমেন্ট নিয়ে তারা যায় ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত। সে এক ভিন্ন জীবন—নৌকায় রান্না, নৌকায় খাওয়া, নৌকায় ঘুম।
বর্ষায় হাওর জেগে ওঠে। জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ছুটে যায় মাছ ধরতে। জাল ফেলে ধরা মাছ যদি নিজের নৌকা ও জালে হয়, তাহলে সে মাছ তার নিজের। কিন্তু মহাজনের নৌকায় উঠলে হিসাব অন্য। সে হয় কামলা বা মজুর। টনকে টন মাছ তুলে দিতে হয় মহাজনের আড়তে—কুলিয়ারচর বা ভৈরবে। সেখান থেকে লাখ লাখ টাকার মাছ যায় দেশের নানা প্রান্তে। অথচ জেলেটি, যে নিজের হাতে মাছ ধরে, তার নিজের জন্য একটি মাছও থাকে না। ফেরার পথে হয়তো মজুরির টাকায় স্থানীয় হাট থেকে চাষের পাঙ্গাশ কিনে বাড়ি ফেরে। যেন সুকান্তের সেই পংক্তি—
“আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে,
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য।”
হাওরের সুখ-দুঃখের এমন গল্প ভেসে বেড়ায় হাওরের বাতাসে। হাওরের জীবন ও জীবিকা জানতে হলে হাওরের মাটির সঙ্গে আত্মীয়তা গড়তে হয়। করচ-হিজলের ছায়ায় বসে হাওরের মায়া না ছুঁলে এই জীবনকে বোঝা যায় না।
প্রকৃতি, জীবন, জীবিকা, প্রেম, ভালোবাসা—সবকিছুর রূপ পাল্টায় মাসে মাসে, ঋতুতে ঋতুতে। বর্ষাই হাওরের সবচেয়ে প্রাণবন্ত সময়। তখন দূর দূরান্তে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো চলে, হাটে-বাজারে মানুষের ভিড় বাড়ে। হাওরের প্রধান বাহন নৌকা ছুটে বেড়ায় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। ফেরির নৌকা না গেলে হাওরের কোথাও পৌঁছানোই যেত না। হাওরের শিশুরা ফেরির নৌকায় করে স্কুলে যায়—অসাধারণ দৃশ্য সেটা।
হাওরে বিয়েশাদি হয় বর্ষায়। থইথই জলের ওপর কাগজ দিয়ে সাজানো নৌকায় যায় বরযাত্রী। মাইক বাজে, গান বাজে, সবাই নাচে। ফেরার পথে নতুন বউ নিয়ে বরযাত্রীদের আনন্দে মুখরিত নৌকা—দেখলে অন্য নৌকা থেকেও লোকজন উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে।
ভরা শীতে যখন মাছের দেখা নেই, পুরুষেরা পাড়ি জমায় শহরে। দরিদ্র জেলে পরিবারে নামে দুঃখের ছায়া। আশপাশে জাল ফেলে সামান্য মাছ পেলে ডালভাত জোটে, না পেলে উপোস।
হাওরের শরীরে যত বেশি জল, ঢেউয়ের জোর তত বাড়ে। সেই ঢেউয়ের আঘাতে বাড়িঘর, স্কুল, হাটবাজার ভেঙে যায়। হাওরের বাড়িগুলো যেসব উঁচু জায়গায় থাকে, সেগুলোকে বলে ‘হাটি’ বা ‘আটি’। বড় হাটি একেকটা পুরো গ্রাম, ছোট হলে দু–তিনটি হাটি মিলে এক গ্রাম। বর্ষায় হাটিগুলো যেন বিশাল স্টিমার, চারদিকে জল। কিন্তু ভয়ও কম নয়—রাতভর ঢেউ এসে আঘাত করে, মাটি ক্ষয়ে যায়, একসময় পুরো হাটি হারিয়ে যায়। নতুন হাটি গড়তে লাগে শ্রম, ঘাম, অর্থ। অর্থ না থাকলে মানুষ হারায় আশ্রয়, হারায় শেকড়ের বন্ধন।
দশ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন হাওরজীবন দেখার সুযোগে বুঝেছি—হাওরের মানুষের মন ঠিক হাওরের মতোই উদার ও বিস্তৃত। অধিকাংশ মানুষ ভাবুক। নৌকা নিয়ে অবারিত প্রান্তরে ঘোরার সময় মন ডুবে যায় ভাবনায়। এই হাওরের মাটিতেই জন্ম হাসন রাজা, রাধারমন, শাহ করিমের মতো অসংখ্য মরমি সাধকের। তাদের কাছে বস্তুজীবন অর্থহীন ছিল। জমিদার হাসন তাই বিলিয়ে দেন হাজার একর জমি, আর বলেন—
“কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার,
লোকে বলে, বল রে ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার।”
হাওরের উদাস মন, মরমি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে হাওরেই স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরের বাড়ি-হাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে একসময়কার জলাবন—হিজল, করচের জঙ্গল—আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ মানুষ নিজের হাতে ধ্বংস করেছে।
হাওর রক্ষায় তাই প্রয়োজন নতুন করে জলাবন সৃষ্টি। হাওরের বুক চিরে পিচঢালা পথ বানানো বন্ধ না হলে হাওরের প্রকৃতি একদিন মৃত্যুর মুখে পড়বে।
অগ্রহায়ণে সোনালি ধানের উৎসব, বাউল গান আর আনন্দমুখর জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হলে হাওর নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রাকৃতিক মাছ ও ধান হাওরের প্রধান সম্পদ, যা দেশের অর্থনীতিকে প্রাণ দেয়। হাওরে পরিকল্পিত পর্যটনেরও অসীম সম্ভাবনা রয়েছে।
হাওরের মানুষের উদার, মানবিক মন আমাদের শিখিয়ে দেয় মানুষ হওয়ার পাঠ। তাই মনুষ্যত্ব, মানবিকতা আর সংকীর্ণতা দূর করতে হলে হাওরের চিরায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। হাওর বাঁচলেই হাওরের সংস্কৃতি বাঁচবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক