ইতিহাসের ইতিহাসের সাক্ষী বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:১৭

বগুড়ার শেরপুরে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো খেরুয়া মসজিদ। এর স্থাপত্যশৈলী, আধ্যাত্মিক পরিবেশ এবং অনন্য নির্মাণকৌশল এখনও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। দেশজুড়ে মুসলিম স্থাপত্যের যে অল্প কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে, তার মধ্যে এই মসজিদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলার খন্দকারটোলা গ্রামের শান্ত-সবুজ পরিবেশে মসজিদটির অবস্থান। চারদিক ঘেরা সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রতিষ্ঠাতার কবর, যা মসজিদের ইতিহাসকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, সুলতানি ও মুগল স্থাপত্যের সমন্বয়ে গড়া এ মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আব্দুস সামাদ ফকির। মীর্জা নবাব মুরাদ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ৯৮৯ হিজরি (১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে) এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। উত্তর-দক্ষিণমুখী এই স্থাপনার বাইরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। ভেতরের অংশ তুলনামূলক ছোট, দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৬ ফুট, যা তৎকালীন সময়ের নির্মাণ শক্তির পরিচায়ক।
তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের চার কোণায় রয়েছে চারটি মিনার। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর-দক্ষিণে আরও দুটি দরজা, সব মিলিয়ে পাঁচটি প্রবেশপথ। ভেতরে রয়েছে তিনটি মেহরাব। ধনুকাকৃতির কার্নিশের নিচে সারিবদ্ধ খিলান এবং অলংকরণ মুগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। দেয়ালের কিছু স্থানে পোড়া মাটির অলংকরণ ফলকও দেখা যায়, যদিও সংখ্যা অল্প।
মসজিদটি নির্মাণে ইট, চুন, শুড়কি ছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে বিশাল আকৃতির কৃষ্ণপাথর। মসজিদের সামনের দেয়ালে একসময় দুটি শিলালিপি ছিল। এর একটি শিলালিপির ভেতরে মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষিত ছিল বলে ধারণা করা হয়, যা পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয়। অপর শিলালিপিটি বর্তমানে করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আকবরের আমলে নির্মিত হওয়ায় দেয়ালের ইটের বিন্যাস, খাড়া প্যানেল এবং ফুল-লতা-পাতার নকশায় যুগের স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
একসময় অবহেলায় নষ্ট হতে বসা এই স্থাপনাটি নব্বইয়ের দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংস্কার করা হয় এবং পুরোনো রূপ ফিরে পায়। তবু মসজিদে যাতায়াতের কাঁচা পথটি এখনও দর্শনার্থীদের জন্য কিছুটা অসুবিধার কারণ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদের দায়িত্বে থাকা সামাদ মিয়া বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশ থেকেও বহু পর্যটক এই মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হলে দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং নতুন প্রজন্ম মুসলিম স্থাপত্য সম্পর্কে গভীর আগ্রহ অর্জন করবে।
মসজিদের মুয়াজ্জিম মো. জুবায়ের বলেন, এই মসজিদই এ অঞ্চলের মুসলিম আমলের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা। আরব থেকে আগত আব্দুস সামাদ ফকির এখানে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল দেখে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন এবং স্থানীয় শাসক জওহর আলী কাকশালের ছেলে মীর্জা মুরাদ খানের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদের মুয়াজ্জিমের দায়িত্ব পালন করছি। প্রতি ওয়াক্তে বিভিন্ন বয়সের মুসুল্লিরা এখানে নামাজ পড়তে আসেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যদি উদ্যোগ নিয়ে মসজিদটি সংস্কার করা হয় তাহলে মুসল্লির সংখ্যা আরও বাড়বে।
অমূল্য স্থাপত্য, শতাব্দী পেরোনো ইতিহাস। সব মিলিয়ে খেরুয়া মসজিদ শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য সম্পদ। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হলে পর্যটনেও যুক্ত হতে পারে নতুন সম্ভাবনা।