ভাষা আন্দোলনে নারী : অস্বীকৃতির ৭২ বছর

আফরোজা পারভীন
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:০৩

সবে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। ১৯৪৭-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংবাদটি ৬ ডিসেম্বর ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়।  ওই দিন দুপুর দুটোয় ছাত্ররা একটি প্রতিবাদ সভা করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক জনাব আবুল কাশেম। এর আগে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়। 
সমাবেশের পর ছাত্ররা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের সম্মুখে ও ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্ররা প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বাসভবনে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। 
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের ১ম অধিবেশন বসে। অধিবেশনে কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বিষয়ক একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বলেন, উর্দুই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে বলে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লোকের অভিমত। যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। 
ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় ‘স্বাধীনতার সূতিকাগার’। ভাষা আন্দোলনে উপ্ত বীজ ক্রমশ চারা হয়েছে, পুষ্ট হয়েছে, রূপ নিয়েছে মহীরুহে। ভাষা আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক নারী অংশ নিলেও নারীর ভূমিকার কথা উচ্চারিত হয়েছে কৃপণতার সঙ্গে। আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই নারীরা ছিলেন পুরোভাগে। পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন বিক্ষোভ-আন্দোলনে- জেলে। পোস্টার  ফেস্টুন লিখেছেন, চাঁদা তুলেছেন, চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের কথা বিশদে জানা যায়। তাদের সবার আলোকচিত্র নেই। এটা বড়ই বেদনার কথা!
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মিছিল বের হয়  সেই মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন নারীরা।  সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বায়ান্নর ২০ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করে। সরকার বিব্রত হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভঙের সিদ্ধান্তে ছাত্রীরাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কৌশল হিসেবে মিছিলের প্রথম সারিতে মেয়েদের রাখা হয়। সেদিন পুলিশের লাঠিতে আহত হন রওশন আরা বাচ্চু, ড. সুফিয়া আহমদ, ড. হালিমা খাতুন, সারা তৈফুর, শামসুন নাহার আহসান, ড. শরীফা খাতুনসহ আরো অনেকে । একুশের সকালে ড. হালিমার দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। তিনি মুসলিম গার্লস ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের  মেয়েদের আমতলার সমাবেশে নিয়ে আসেন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি  গোপনে ভাষাসৈনিক নাদেরা  বেগমের বাসায় যান।  মিটফোর্ড হোস্টেলের ছাত্রীরা যাতে আমতলার প্রতিবাদ সভায় যান এ সংক্রান্ত চিঠি নিয়ে আসেন। ছাত্রীরা সেদিন ৪ জনের ছোট  ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। একটি দলে হালিমা খাতুন ছাড়াও ছিলেন জুলেখা (পুতুল), নূরী ও  সেতারা। 
পুরনো আর্টস বিল্ডিংয়ের দরজায় পুলিশের ব্যারিকেড ঠেলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে পথে  বের হয়ে পড়েন। তারপর  ছোট ছোট আরো দুটি দল পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বের হয়ে আসে।  মেয়েদের তৃতীয় ও চতুর্থ দলটিকে পুলিশ এরেস্ট করে ভ্যানে তুলে নিয়ে বহুদূরে ছেড়ে দেয়। সারা তৈফুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মহিলা হল ‘চামেলি হোস্টেল’-এ থাকতেন। ড. শাফিয়া খাতুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন তিনি। হলের দুই শতাধিক ছাত্রীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উজ্জীবিত করেছিলেন তারা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে যাওয়ার সময়  তিনি পায়ে আঘাত পান। শামসুন নাহার আহসান সঙ্গীদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বেরিয়ে আসার সময় পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠিপেটার মধ্যেও পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে  যেতে থাকেন। কাঁটাতারে আটকা পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হন শরিফা খাতুন। এরপরও হোস্টেলের দেয়াল টপকে সমাবেশে যোগ দেন।
এ দিকে ইডেন কলেজের হোস্টেল থেকে ২০-২৫ জন ছাত্রী ব্যানার নিয়ে বের হন। শরিফা খাতুনদের দলটি সামনে দিকে এগোচ্ছিল। কিছু দূর এগোবার পর পুলিশ মিছিল থেকে ছাত্রছাত্রীদের ধরে ট্রাকে করে নিয়ে যায়। বিকেল ৩টার দিকে গোলাগুলি শুরু হয়। এ ঘটনায় গুলিতে হতাহত হন অনেকে। বাঙালি জাতির ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার অসাধারণ এক উত্থানে আন্দোলিত হয়েছিল সারাদেশ। সেদিন শহিদ হন সালাম, জব্বার, রফিক, শফিকসহ অনেকে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতারাতি শহিদ মিনার নির্মিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দলে দলে সবাই শহিদ মিনারে আসেন। ফুলে ফুলে ভরে যায় শহিদ মিনার। অনেকে টাকা পয়সা দান করেন। মহিলারা গায়ের গয়না খুলে দেন শহিদ বেদিতে। ভাষা আন্দোলনে সাধারণ গৃহবধূরা পিছিয়ে ছিলেন না। অধ্যাপক আবুল কাশেমের আজিমপুরের বাসাটি ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। ভাষা আন্দোলনের বৈঠকসমূহ এ বাড়িতে হতো। আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলার উপর ভার ছিল নেতাকর্মীদের রান্না, খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা, পোস্টার লেখা, পোস্টারের জন্য আঠা  তৈরি এবং সৈনিক পত্রিকা ভাঁজ করার। তিনি ননদ রহিমা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে দায়িত্ব পালন করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ বাড়িতে হানা দেয়। রাহেলা স্বামীসহ ভাষাসৈনিকদের রক্ষা করার  জন্য গেটে পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। তিনি পুলিশকে কিছু সময় আটকে রাখেন। সেদিন তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির ফলে অনেক ভাষাসৈনিক গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। 
ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে গিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহিদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করায় বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ছালেহা বেগম। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রী। মমতাজ বেগমের নাম ছিল ‘কল্যাণী’। নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে একুশের মিছিল মিটিং-এ যোগ দেয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রস্তাব ছিল তার কাছে। রাজি হননি। ফলে স্বামী তাকে তালাক দিয়েছিল। 
কুমিল্লার ভাষাসংগ্রামী লায়লা নূর ছিলেন একুশের প্রতিটি মিছিল মিটিং-এর অগ্রভাগে । নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২১ দিন জেল খেটেছেন।  যশোরের হামিদা রহমান ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। হুলিয়া জারি হয়েছিল তার নামে। পুরুষের ছদ্মবেশে যোগ দিতেন সভা সমিতির মিছিলে। নড়াইলের ভাষাসংগ্রামী রিজিয়া খাতুন এবং কে এফ সুফিয়া বেগম বুলবুল একুশের প্রতিটি মিটিং মিছিলে ছিলেন। নড়াইলে প্রথম শহিদ মিনার তারা নিজ হাতে গড়েছিলেন। পুলিশ সে শহিদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। 
প্রতিভা মুৎসুদ্দি ওতপ্রোভভাবে জড়িত ছিলেন চট্টগ্রামে ভাষা সংগ্রামে। প্রতিটি মিটিং, মিছিলে থাকতেন। ট্রাক নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে একুশের স্লোগান দিতেন। ভাষা আন্দোলনে সিলিটের নারীদের ছিল অসামান্য অবদান। ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার সিলেট সফরে এলে একটি মহিলা প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে দেখা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তারা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছেও স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন মহিলা মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী জোবেদা খানম, সহকারী সভানেত্রী  সৈয়দা শাহেরবানু চৌধুরী, সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, জাহানারা মতিন, রোকেয়া বেগম, শামসী কাইসার রশীদ, নূরজাহান বেগম, সুস্মিতা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, সামসুন্নেসা খাতুন ও অন্যান্য। ভারতের ‘আনন্দ বাজার’ ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করে।  
ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। স্থানাভাবে তাদের মাত্র কয়েকজনের কথাই এখানে উল্লেখ করা গেল। যথাযোগ্য স্বীকৃতিও পাননি তারা। এ দেশের আনাচে-কানাচে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক নারী অংশ নিয়েছেন ভাষা সংগ্রামে। গবেষণার অভাবে এখনও অনেকের অবদানই অনুদ্ঘাটিত। পরিতাপের কথা, বহমান সময়ে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছেন ভাষা সংগ্রামীরা। বিলুপ্ত হচ্ছে সে সময়ের দলিল দস্তাবেজ। ভাষাসংগ্রামী নারীদের অন্ধকার থেকে আলোয় তুলে এনে স্বীকৃতি প্রদান এখন সময়ের দাবি।