জন্ম থেকেই জ্বলছে আফগান-পাকিস্তান সম্পর্ক

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৩:১৪


আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই বিবাদপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু, সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছে এখনো। 
এর মূলে রয়েছে ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ নির্ধারিত আফগানিস্তানের ‘ডুরাল্ড লাইন’ সীমানা। পরে দেশভাগের সময়ও বিতর্কিত সেই ডুরাল্ড লাইনই থেকে যায় পাকিস্তানের সীমানা। যা সব সময়ই অবৈধ বলে বিবেচনা করেছে আফগানিস্তান। দিনে দিনে বেড়েছে বই কমেনি। 
চলমান এই সীমান্ত বিরোধ, শরণার্থী সংকট, উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর কার্যক্রম এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন-সবমিলিয়ে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই জ্বলছে প্রতিবেশী দুই দেশ। ১৯৭০-এর দশক থেকে সোভিয়েত আগ্রাসন, গৃহযুদ্ধ, তালেবান উত্থান ও সন্ত্রাসবাদ এই দ্বিপাক্ষিংকি সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। এপি।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ও সীমান্তসংলগ্ন পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা প্রদেশে সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের ঘটনা দুই দেশের পুরোনো বৈরিতা আরও চড়াও হয়ে উঠেছে। শুক্রবার ওই হামলার নিন্দা জানিয়েছে আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী। 
একইদিনে পাকিস্তানকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভারত সফররত আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। আফগানিস্তান কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ বা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে না থাকলেও লন্ডন নির্ধারিত দুই দেশের সীমান্ত লাইনই এই সংঘাতের মূল কারণ। 
ঐতিহাসিকভাবে  সংবেদনশীল দুদেশের বিতর্কিত ডুরাল্ড লাইন বরাবর আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত তালেবান ক্ষমতা দখলের (১৫ আগস্ট, ২০২১) পর আরও বেড়েছে। 
পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য দেশটির বিমানবাহিনী আন্তঃসীমান্ত হামলা, সীমান্ত পেরিয়ে আফগান ভূখণ্ডে হামলাগুলোই কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। 
ইসলামাবাদের দাবি, সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে পাকিস্তানে হামলা চালায়। তবে বরাবরই এই দাবি অস্বীকার করেছে আফগানিস্তান। 
তালেবান নেতারা দাবি করেন, পাকিস্তান আফগান ভ‚খণ্ডে হামলার অজুহাতে তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। এই দ্বৈত মতবাদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি বড় ঘাতক হয়ে উঠেছে। তবে দুই দেশের টানাপোড়েনের সূত্রপাত মূলত ডুরাল্ড লাইন থেকেই। 
১৮৯৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ব্রিটিশ কূটনৈতিক মার্টিমার ডুরাল্ড ও আফগান রাজা আমীর আবদুর রহমান খান তাদের নিজ নিজ দেশের সীমা নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশ-ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে ডুরাল্ড লাইন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৯ সালের অ্যাংলো-আফগান চুক্তির মাধ্যমে লাইনটি সামান্য পরিবর্তিত হয়। পরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডুরাল্ড লাইনকেই নির্ধারিত করা হয়। যা দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনের সূত্রপাত করে। 
পাকিস্তান এটিকে সীমান্ত হিসাবে মানলেও আফগানরা কখনো ডুরাল্ড লাইনকে স্বীকার করেননি। এ নিয়ে কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়েছে দুই দেশ। এই সীমান্ত বিতর্ক আজও দুই দেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে। এই টানাপোড়েনের প্রভাব বহুমাত্রিক। 
পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা প্রচেষ্টা জটিল করছে। এছাড়া বাণিজ্য ও পরিবহণ ব্যাহত হচ্ছে এবং আঞ্চলিক সংহতির উদ্যোগগুলোও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপগুলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার হুমকি সৃষ্টি করছে। এছাড়া পাকিস্তানের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপকে আরও তীব্র করছে। 
বিস্তৃত অঞ্চলের জন্য, এই অমীমাংসিত বিরোধ একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে। যা বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বাহ্যিক হস্তক্ষেপকে উসকে দিতে পারে। প্রসঙ্গত, ডুরাল্ড লাইন আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ প্রদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান এবং গিলগিট-বালটিকস্তানকে পৃথক করেছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া হামলাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, কাবুল ও পাকতিকায় সংঘটিত বিস্ফোরণের জন্য পাকিস্তান দায়ী। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো প্রমাণ বা তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। 
মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে আরও বলেছে, ‘এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ড অযৌক্তিক এবং আমাদের সার্বভৌমত্বে স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা আমাদের মাতৃভূমি রক্ষা করার আইনগত অধিকার সংরক্ষণ করি এবং যে কোনো উত্তেজনার পরিণতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে ভোগ করতে হবে।’ 
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান ভারত সফররত আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিও।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আফগানদের ধৈর্য পরীক্ষা করো না। যদি করো তাহলে ব্রিটিশ, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে জিজ্ঞাসা করো আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলার পরিণতি কী হয়।’
রাজধানী কাবুলের এই প্রথম বিমান হামলা সম্পর্কে শনিবার সতর্ক বার্তা আফগানিস্তানবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি  (২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ থেকে ১৯ অক্টোবর, ২০২১) জালমাই খালিলজাদও। বলেন, পাকিস্তানের কাবুলে বিমান হামলা বৃহত্তর সংঘর্ষকে উসকে দিতে পারে এবং পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।