বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দিল্লিতে কার্যত ‘গৃহবন্দি’ দশায় কাটাতে হচ্ছে বলে ভারতেরই এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর বেরিয়েছে, তা পুরোপুরি খারিজ করে দিচ্ছে দিল্লি। ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জড়িত একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জোর দিয়ে জানিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা ভারতের অতিথি, তাকে সম্মানিত অতিথির মর্যাদাতেই এখানে রাখা হয়েছে।’ কোনও গৃহে, সেফ হাউজে, বা অতিথি নিবাসে তাকে ‘বন্দি’ রাখার প্রশ্নই ওঠে না, এ কথাও তারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
তবে ভারতে তার এবারের আসাটা যেহেতু একেবারেই অস্বাভাবিক (‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি’) একটা পরিস্থিতিতে, তাই সেটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শেখ হাসিনাকেও কিছু ‘প্রোটোকল’ মেনে চলতে হচ্ছে— এ কথা তারাও স্বীকার করছেন। কিন্তু এই প্রোটোকলগত বিধিনিষেধগুলো ঠিক কী রকম? সংশ্লিষ্ট নানা মহলের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জানতে পেরেছে তা এরকম:
১. ভারতে থাকাকালীন শেখ হাসিনাকে কোনও দেশি বা বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে, বা সাক্ষাৎকার দিতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ভারতের বহু শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা বা চ্যানেল (ও সেইসঙ্গে নানা আন্তর্জাতিক মিডিয়া) তার সাক্ষাৎকার পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু ‘হোস্ট’ হিসেবে ভারত সেসব অনুরোধই আপাতত নাকচ করে দিয়েছে।
২. শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন ‘ডিব্রিফিং সেসনে’ এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ভারতে থাকাকালীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি যদি প্রকাশ্যে লিপ্ত না-হন, সেটাই সমীচীন হবে। অর্থাৎ ভারতের মাটিতে থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি যদি প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া, বা কোনও কর্মসূচির আহ্বান জানানো থেকে বিরত থাকেন, সেটাই ‘উভয়ের জন্য মঙ্গল’। আসলে দিল্লি এমন কোনও বার্তা দিতে চাইছে না যে, ভারতের মাটিতে তাকে আশ্রয় দিয়ে তারপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
৩. তবে এর মানে এই নয় যে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মহল থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। বস্তুত গত ৫ আগস্ট দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করার পর থেকে তিনি নিয়মিতই তার দলীয় নেতাকর্মী, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী মহল ও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, ফোনে কথাও বলছেন। এমনকি বাংলাদেশের কোনও কোনও জেলার আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে তার ফোনে কথাবার্তার অডিও ভাইরালও হয়েছে। শেখ হাসিনার ‘ব্যক্তিগত নম্বর’ যাদের কাছে আছে, তারা অনেকেই গত এক মাসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলেছেন বলেও এই প্রতিবেদক নিশ্চিত হতে পেরেছেন।
ভারতের এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্তরে তার রুটিন যোগাযোগের সব চ্যানেলই চালু আছে। যতদূর জানি, তাকে শুধু প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে, আর তিনিও সেটা মেনে চলছেন।’
৪. পারিবারিক স্তরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ ও কথাবার্তা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা জয় অবশ্য এখনও ভারতে আসেননি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার সুবাদে পুতুল এখন রয়েছেন দিল্লিতেই। মেয়ের সঙ্গেও হাসিনার ইতোমধ্যে একাধিকবার মুখোমুখি (‘ইন-পার্সন’) দেখা হয়েছে, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই, তবে সঙ্গত কারণেই তার কোনও বিবরণ কোথাও প্রকাশ করা হয়নি।
বস্তুত শেখ হাসিনাকে ঠিক কোথায় ও কীভাবে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে ভারত এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে একটি শব্দও বলেনি। ভারতের পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে, তারা যা বলছেন, সেটার মূল কথাটা হলো— শেখ হাসিনা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভারতে ‘সাময়িকভাবে’ চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং ভারত তাকে আতিথেয়তা দিচ্ছে। ফলে এটা নিয়ে বাইরে ফলাও করে বলার কিছু নেই, বরং বন্ধুপ্রতিম এই অতিথির সম্মান ও মর্যাদা বিবেচনায় নিয়ে পুরো জিনিসটা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখাই বাঞ্ছনীয়।
তবে আগামী দিনে ভারত যদি তাকে ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, তখন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে– এটাও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন। তখন হয়তো এই জাতীয় বিধিনিষেধ অনেকটাই প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
আসলে শেখ হাসিনার যে রকম ‘রাজনৈতিক প্রোফাইল’ এবং ভারতের সঙ্গে তার যে প্রায় অর্ধশতাব্দীর সুসম্পর্ক– তাতে ভারত তাকে এ দেশে আশ্রয় দিলে ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ দিয়েই থাকতে দেবে, দিল্লির পর্যবেক্ষকরা সে রকমই ধারণা করছেন।
দিল্লির জেএনইউ-তে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক অধ্যাপকের কথায়, ‘রাজনৈতিক আশ্রয় যাদের দেওয়া হয়, তাদের এক একজনের ক্ষেত্রে ভারতে বসবাসের শর্ত এক একরকম হয়। দালাই লামা যেমন ভারতে তার প্রথম দিন থেকে তিব্বতি ধর্মগুরু হিসেবে সব ধরনের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কার্যকলাপ চালানোর অনুমতি পেয়েছিলেন, আফগান প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ-র পরিবার আবার তা পাননি।’ তবে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ভারতের একজন ‘অত্যন্ত সম্মানিত অতিথি’ এবং তাকে সেই প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েই রাখা হচ্ছে বলে ভারতের কর্মকর্তারা একান্ত আলোচনায় জানাচ্ছেন।
এমনই একজন কর্মকর্তার কথায়, ‘এমনও দেখলাম, কোথাও কোথাও লেখা হচ্ছে— ভারত নাকি তাকে সুপারশপে দৈনন্দিন বাজার করতেও যেতে অনুমতি দিচ্ছে না। এর চেয়ে গাঁজাখুরি মিথ্যে কথা আর কিছু হতেই পারে না। বরং রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে আপাতত তার যাবতীয় দেখাশুনো, ভালোমন্দ, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ভার আমরা নিয়েছি— এটা মাথায় রাখলেই বুঝতে পারবেন, আমি কী বলতে চাইছি!’
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন