‘শ্যামল ছায়া’ উপন্যাসটি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস। এটি প্রথম অন্য প্রকাশ প্রকাশনী থেকে ২০০৩ সালে মার্চে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ না করে কয়েকজন মুক্তি বাহিনীর সদস্যের জবানবন্দী ও দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের অন্তরের কথা।
সাল ১৯৭১, দেশে তখন ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা। হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালাচ্ছে শহরে, বন্দরে, গ্রামের ঘরে ঘরে। পথে-প্রান্তরে প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। সেই সময় দেশের মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়। একদল শান্তি বাহিনী ও রাজাকার নামে পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে সাহায্য করে। আরেক দল দেশমাতৃকা রক্ষার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়।
তেমনই তেজী যোদ্ধা ক্লান্ত রাতে নৌকার পাটাতনে জেগে থাকা পাঁচ জোড়া চোখ হুমায়ুন, জাফর, আনিস, মজিদ এবং পথপ্রদর্শক মাঝি হাসান আলী। তাদের নিয়েই উপন্যাস শ্যামল ছায়া। তাদের পাঁচজনের উদ্দেশ্য হলো মেথিকান্দার ক্যাম্প দখল করা। যেটা দখল করতে বারবার পরাজিত হচ্ছে মুক্তি বাহিনী, শহীদ হয়েছেন বহু মুক্তিযোদ্ধা। যার ফলে ক্যাম্পটি নাম পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুকূপ হিসেবে।
উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের বয়ানে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের একেকটা ঘটনা। যুদ্ধের সময় প্রিয়জনদের স্মৃতি, তাদের কাছে পাওয়ার আকুতি, মৃত্যুর ভয়, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, প্রিয়জনদের হারানোর প্রতিশোধ, বিবেকের দংশন এবং মানসিক টানাপোড়েনে মিলিত উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র।
রাজাকারদের প্রতি আমাদের চিরাচরিত ভাবনার ভিন্নমত প্রকাশ করা হয়েছে উপন্যাসে। রাজাকার কমান্ডার কেরামত মাওলানা হিন্দুদের ঘর কেন অন্যায় ভাবে পোড়ানো হচ্ছে, এটার প্রতিবাদ করায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের প্ররোচনায় দু’মুঠো ভাতের স্বপ্নে হাসান আলী যোগ দেয় রাজাকার বাহিনীতে। সে দেখেছে নরপিশাচদের নৃশংসতা, দেখেছে লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং পাকবাহিনীর হাতে পরিচিতদের মৃতদেহ। তখনই সে বিবেকের দংশনে নীল হয়েছে। আত্মগ্লানিতে নরক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে ফিরেছে ন্যায়ের পথে, দেশের পথে। কোরআন নিয়ে শপথ করেছেন। এর প্রতিশোধ নেবেন। যদি এর শোধ না তুলতে পারেন, তাহলে তার নাম হাসান আলি না, সে বেজন্মা।
মশার কামড় সবাই সহ্য করতে না পেরে কেরোসিন মাখায় শরীরে। মুক্তিযোদ্ধা জাফর ভয়ে কেরোসিন মাখায় না। কেরোসিনকে ভয় পেলেও সে মিলিটারি বাহিনীর সামনে ভীতু নয়। বীরের মতো লড়াই করতে পারে। হুমায়ুন একটু দুর্বল হলেও সম্পূর্ণ দলকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। মাঝি হাসান আলীর শ্রবণশক্তি খুবই প্রখর। শত্রু বাহিনীর লঞ্চ, স্টিমারের শব্দ শুনে সবাইকে সাবধান করে, সতর্ক করে। আগে সে রাজাকার থাকলেও এখন সে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করে। দাঁড় টেনে নিয়ে যায় নিরাপদ স্থানে।
মজিদের বাবাকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। মা-বোনকে ফেলে চলে আসে দেশমাতৃকার সেবায়। যুদ্ধ শেষে সে ময়মনসিংহে ফিরে যাবে। সেখানে গিয়ে তার মা-বোনকে খুঁজবে। আনিস ভয় পায় তার স্বপ্ন নিয়ে। তার মন বারবার বলছে, হুমায়ুন যুদ্ধে মারা যাবে। কারণ সে তার ছোট বোনকে নিয়ে যেভাবে স্বপ্ন দেখেছিল; ঠিক সেভাবেই তার ছোট বোন মারা যায়। যদিও সে হুমায়ুনের মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করে সব সময়, কিন্তু সে নিজেই অসুস্থ। তার এ অসুস্থতা নিয়েই মিলিটারি দমনের অপারেশনে নামে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত শ্যামল ছায়ার উদ্দেশ্যে দিগন্তের পানে ছোটে। দেশমাতাকে শত্রুর থাবা থেকে মুক্ত করার নেশায়। স্বাধীন দেশেকে নিয়ে ভাবনায় দেশপ্রেমের এক অন্যতম মাত্রা ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। একজন পাঠককে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র ভাবতে বাধ্য করে। তাদের চেতনাকে ধারণ করতে বাধ্য করে। শত্রু মোকাবিলা করার শক্তি জোগায়। একাত্তরের চেতনা আমাদের অন্যায়, নিপীড়ন ও স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দ্রোহকে প্রজ্জ্বলিত করে। পরে অধিকার এবং ন্যায়সঙ্গত সব আন্দোলনে এর প্রতিফলন ঘটেছে।