বিশ্ব অর্থনীতি আজ এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত, মোটামুটি সব অর্থনীতিই চাপের মুখে। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ উত্তেজনা, অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ডলার সংকট ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। চীন ও ভারতের মতো অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর প্রবৃদ্ধির ধীরগতি লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যযুদ্ধ, সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়া, জ্বালানির মূল্য অস্থিরতা, সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি দীর্ঘ অনিশ্চয়তার সময় পার করছে।
বাংলাদেশও এই ঢেউয়ের বাইরে নয়। অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভের চাপ, রেমিট্যান্সে স্থবিরতা, রফতানি বাজারে সংকট ইত্যাদি মিলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নীতি নির্ধারকদের চিন্তিত করছে। এমন বাস্তবতায় টেকসই প্রবৃদ্ধি রক্ষার কৌশল খোঁজা সময়ের দাবি।
শুরুতেই বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার প্রেক্ষাপটের কয়েকটি বিষয়ের দিকে খেয়াল করা যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ উচ্চ সুদের হারের কারণে ডলার বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী হয়েছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। বাংলাদেশের টাকাও এর ব্যতিক্রম নয়। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের মতো খাদ্যপণ্যের সরবরাহে বড় ধাক্কা দিয়েছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা জ্বালানি তেলের দাম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ও মুদ্রাস্ফীতিতে পড়েছে। এদিকে চীন-মার্কিন উত্তেজনা থেকে শুরু করে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিবেশ এখন অস্থির। বাংলাদেশি পোশাক শিল্প বিশেষত মার্কিন ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। ক্রেতারা বিকল্প দেশ খুঁজতে শুরু করলে রফতানি আয় হুমকির মুখে পড়তে পারে। এছাড়া চীনের প্রবৃদ্ধি কমেছে, ভারতের প্রবৃদ্ধিও স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরার অপেক্ষায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ঋণসঙ্কটে, পাকিস্তান মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত। ফলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমন্বয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যদি অস্থিরতা দেখা যায়, বাংলাদেশ সেখান থেকে বাইরে থাকতে পারবে না। কিছু ঝুঁকি আমাদের উপরও আসে। যেমন, পোশাক শিল্পের কথাই ধরুন। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ এর বেশি তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা, সুদের হার বৃদ্ধি, যুদ্ধ বা বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে, পোশাক ও বিলাসবহুল ভোক্তা পণ্যের চাহিদা কমে যায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যারা বাংলাদেশের প্রধান ক্রেতা, তারা অর্ডার কমিয়ে দেয় বা দাম নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজার সংকুচিত হলে এই খাতেই সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লাগে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নীতিগত পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের মতো বাড়ছে না। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় আমদানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বৈদেশিক রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। একইসাথে, প্রকল্প ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যয় নির্বাহ করাও বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। ভবিষ্যতে যা হবে, সেটাও আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এজন্য টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কিছু কৌশলগত পরিকল্পনা ও কার্যকরী প্রয়োগ প্রয়োজন। যেমন, বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত থেকেই আমাদের অধিকাংশ রফতানি আয় আসে। অথচ চামড়া, ওষুধ, সিরামিকস, কৃষিপণ্য, হিমায়িত মাছ, হস্তশিল্প ও হালকা প্রকৌশল পণ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এই খাতগুলোকে উপযুক্ত পলিসি ও প্রণোদনার মাধ্যমে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে। একইসাথে এক বা দুই দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার নতুন বাজার খুঁজতে হবে।
আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ একচেটিয়াভাবে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে এখনই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার শ্রমবাজারকে অনুসন্ধান করা জরুরি। মালয়েশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, বেলারুশ, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, চিলি এমন আরো অনেক দেশ এখন দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মীর সংকটে ভুগছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এই বাজারগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিক রফতানির নতুন সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে।
বর্তমানে আমাদের প্রবাসীরা স্বল্পদক্ষ বা অদক্ষ। অথচ উন্নত দেশগুলোয় চাহিদা মূলত আধাদক্ষ ও দক্ষ কর্মীর। তাই বিদেশগামী কর্মীদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা উচিত। ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, ওয়ারেল্ডার, নার্সিং, কেয়ারগিভার, হোটেল ব্যবস্থাপনা, আইটি ও ডিজিটাল মার্কেটিং এই খাতগুলোতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুললে আমরা সহজেই নতুন শ্রমবাজারে নিজেদের ভালো অবস্থান নিশ্চিত করতে পারব এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে, হুন্ডি নিরুৎসাহিত করে বৈধ চ্যানেলে প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিলাসপণ্য ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রফতানি আয়ের সঠিক রিটার্ন দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও রিজার্ভ শক্তিশালী হবে।
কর ফাঁকি রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়ন ব্যয়ে অগ্রাধিকার খাত নির্ধারণ করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কমাতে হবে। এছাড়া, বর্তমানে বাংলাদেশের আইটি ফ্রিল্যান্সাররাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রুপ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতির যথাযথ সহায়তা না থাকায় আমরা এখনো রফতানিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারিনি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সহজ পেমেন্ট গেটওয়ে, কর ছাড় এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর রফতানি খাত থেকে শত শত কোটি ডলার আয় করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম আমাদের অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে।
বিদেশ নির্ভরতা যত বাড়ে, ঝুঁকিও তত বাড়ে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিই হতে পারে টেকসই সমাধান। কৃষিভিত্তিক শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প, ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো সম্ভব।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক কম। জাহাজে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে পণ্য আনতে যত সময় ও খরচ লাগে, এক্ষেত্রে সেটা লাগবে না। আঞ্চলিক বাজারে চাহিদা থাকলে রপ্তানি বহুমুখীকরণও সম্ভব।
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা কখন শেষ হবে কিংবা আদৌ শেষ হবে কিনা, কারোই জানা নেই। বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য নীতি সমন্বয়, অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও সুশাসনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। টেকসই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে চাইলে সুনির্দিষ্ট নীতি ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ ছাড়া বিকল্প নেই। আজ যে প্রস্তুতি নেব, সেটিই আগামী দিনের টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে দেবে।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন