চলে গেলেন ৭০ ও ৮০’র দশকের ‘তুখোড়’ উইলোবাজ বেলাল

স্পোর্টস ডেস্ক
  ২৪ জুলাই ২০২৫, ২৩:১২

রাত প্রায় ১২টা। এমন সময় ফেসবুকে একটি সংবাদ হাতেগোনা কয়েকজন শেয়ার করেছেন। কোটি কোটি পোস্টের ভীড়ে হয়তো সেভাবে কেউ তা খেয়ালও করেননি। তবে আজ বৃহস্পতিবার দিনের ভোরের আলো ফুটতেই অনেকের চোখে পড়ে সেই পোস্ট। যা দেশের ক্রিকেটের জন্য এক নিদারুণ দুঃসংবাদ, তা জেনে যান ক্রিকেটপাড়ার অনেকেই।
সেই দুঃসংবাদ শুনে ক্রিকেটার, সংগঠক, কোচিং স্টাফ, ক্লাব কর্তা, গ্রাউন্ডসম্যান, কিওরেটর ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাই শোকে মুহ্যমান। ক্রিকেটাঙ্গনের সবাইকে কাঁদিয়ে হঠাৎ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন ৭০ ও ৮০ এর দশকের তুখোড় ক্রিকেটার বিগহিটার মীর বেলায়েত হোসেন বেলাল।
গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় হঠাৎ মারা যান দেশের হয়ে প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলা বেলায়েত হোসেন বেলাল (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তরুণ প্রজন্ম হয়তো তাকে চেনে না। তার সম্পর্কে জানে না। জানার কথাও না। কারণ, তিনি খেলা ছেড়েছেন ৮০ এর দশকের শেষ ভাগে। এরপর ৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দীর অন্তত ১০-১২ বছর ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন মীর বেলায়েত হোসেন বেলাল।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, বিসিএল ও ন্যাশনাল লিগের বহু খেলায় ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন ময়মনসিংহের সাবেক ক্রিকেটার বেলাল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত তিন চার বছর ধরে তাকে ম্যাচ রেফারির ভূমিকায়ও দেখা যায়নি।
আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ দুই বছর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায়ও ছিল সমস্যা। ময়মনসিংহে নিজ বাড়িতেই থাকতেন বেলাল। কিন্তু হায় সেই আর্থ্রাইটিসই কেড়ে নিয়েছে এই দুর্দান্ত ক্রিকেটারের প্রাণ!
কতই বা বয়স হয়েছিল? সমবয়সী সাবেক ক্রিকেটার সংগঠক জালাল ইউনুস এবং নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৭১-৭২ বছর বয়স হয়েছিল বেলালের।
কে ছিলেন বেলাল? কী ছিল তার পরিচয়? তিনি ব্যাটার, বোলার নাকি অলরাউন্ডার? ঘরোয়া ক্রিকেট ও জাতীয় দলেই বা তার অবস্থান কেমন ছিল?
বেলালের সহযোদ্ধা ক্রিকেটপাড়ার অতি পরিচিত মুখ আবাহনীর তিন ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব জালাল ইউনুস, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও নামী প্রশিক্ষক ওয়াহিদুল গনি ও সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার এবং বর্তমান কোচ সাইফুল ইসলাম সঙ্গে একান্ত আলাপে দিয়েছেন অনেক তথ্য।
ওপরে যাদের কথা বলা হলো তাদের তিন জনই ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে অদ্যবধি আবাহনী ক্লাবের সঙ্গেই জড়িত। তাদেরই সতীর্থ ছিলেন বেলাল। যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার শোকাতুর হয়ে পড়েছেন জালাল ইউনুস, ববি ও লিপু। তারা তিনজনই একমত, বেলাল খেলোয়াড়ি জীবনে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা হার্ড ও বিগ হিটার ছিলেন। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ভারি শরীর নিয়েও দারুণ ফিট ছিলেন বেলাল। শর্ট স্প্রিন্টে ছিলেন খুবই দক্ষ। তার সমসাময়িক অন্যান্যরা বেলালের সঙ্গে ৫০ মিটার দৌড়ে পারতেন না।
প্রায় সমবয়সী ওয়াহিদুল গনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বেলালের সঙ্গী। তারা একসঙ্গে ৪ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একসঙ্গে খেলেছেন।
অন্যদিকে সাইফুল হলেন বেলালের নিজ শহর ময়মনসিংহেরই সন্তান। সবার একটাই কথা, নিপাট ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন বেলাল। ভোজন রসিক, হাসিখুশি বেলালকে ৭০ ও ৮০ এর দশকের প্রথমভাগে আবাহনীর ‘প্রাণ’ বলে অভিহিত করেছেন জালাল, ববি ও লিপু।
ঢাকা লিগে বেলালের প্রথম দল কী? তিনি কোন কোন ক্লাবের হয়ে খেলেছেন? এই তথ্যগুলো দিয়েছেন বেলালের ছেলেবেলার সহচর আনোয়ার। তারা দুজনই ময়মনসিংহ শহরে বড় হয়েছেন এবং এক সময় ময়মনসিংহের নামি আল হেলাল ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেছেন। বেলালের দুই বছরের ছোট হলেও একসঙ্গে খেলে ঢাকা লিগে নাম লিখিয়েছেন আনোয়ারও।
আনোয়ার জানান, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে বেলালের প্রথম দল টাউন ক্লাব। কালের আবর্তে টাউন ক্লাব এখন আর নেই। তবে ৭০ ও ৮০’র দশকে টাউন ক্লাব ছিল ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে এক প্রতিষ্ঠিত দল। সেই ক্লাবে অনেক নামি ক্রিকেটার খেলেছেন। ময়মনসিংহের নামি ক্রিকেটার রাম চাঁদ গোয়ালা ও অলক চক্রবর্তীসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় ক্রিকেটারের ঢাকার ক্রিকেটে প্রথম দল ছিল টাউন ক্লাব।
৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত ১৯৭৬-১৯৭৭ মৌসুমে টাউন ক্লাব ছেড়ে আবাহনীতে যোগ দেন বেলাল। ছেলেবেলার বন্ধু ও সঙ্গী ক্রিকেটার বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট দলের অন্যতম শীর্ষ কর্তা আনোয়ার জানান, ক্রিকেটার আজম ও আবাহনীর কর্মকর্তা বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী শাহর হাত ধরে বেলাল আবাহনীতে যোগ দেন।
এক টানা অনেকদিন আবাহনীতে খেলার পর ৮০ এর দশকের মাঝমাঝি বেলাল আবাহনী ছেড়ে চলে যান তখনকার নামি দল রূপালী ব্যাংকে। রূপালী ব্যাংকে কয়েক বছর খেলে বেলাল নাম লেখান অগ্রণী ব্যাংকে। অগ্রণী ব্যাংক থেকেই খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করেন।
ক্রিকেটীয় জীবনে বেলাল ছিলেন একজন দুর্দান্ত ব্যাটার। তখনকার লো উইকেটেও তার ‘বিগ হিট’ গুলো এখনো অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ৭০ ও ৮০ এর দশকে যারা নিয়মিত ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট দেখতেন, তাদের সবাই একমত যে, বেলাল ছিলেন সেই সময় দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বিগ হিটারদের অন্যতম। যিনি অনায়াসে বলে কয়ে উইকেটের সামনে ও দু’দিকে ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে পারতেন। বেশ ভারী শরীর নিয়েও মিডল অর্ডারে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি নিয়মিত উইকেটকিপিং করেছেন বেলাল।
বিগ হিটিংয়ে খুব দক্ষ বেলাল ১৯৭৯ সালে প্রথম আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেন। এরপর ১৯৮৪-১৯৮৫ পর্যন্ত জাতীয় দলে এক টানা খেলেছেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় হওয়া দক্ষিণ এশীয় এসিসি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের নিয়মিত সদস্য বেলাল ওই আসরের সেরা পারফর্মারও হয়েছিলেন।
খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই খানিক স্থুলকায় ছিলেন বেলাল। খেলা ছাড়ার বেশ কয়েক বছর পর আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হন তিনি এবং স্বাভাবিক চলাফেরায় অসুবিধা অনুভব করেন।
গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ বেলালের স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হতো। তাই ময়মনসিংহ শহরে নিজ বাসাতেই থাকতেন তিনি। তবে গত কয়েকদিন আগে বেশি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। সেখান থেকে বাসায় ফিরে অবশেষে গতকাল বুধবার (২৩ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টায় ইহকাল ত্যাগ করেন।
আজ বাদ জোহর বেলালের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে তার নিজ বাসা ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ মসজিদে।