গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে প্রথম প্রেসিডেন্সয়াল বিতর্কে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পারফর্মেন্সে হতাশ হয়ে পড়েছে ডেমোক্রেটরা। আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে তিনি কি পুন:নির্বাচিত হতে পারবেন? এখন তার পরিবর্তে ডেমোক্রেটরা কি অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবে? নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, হ্যাঁ, এটাও সম্ভব, কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক উথালপাথাল শুরু হতে পারে। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি স্বয়ং নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে ভিন্ন কথা।
এই পর্যায়ে এসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিবর্তে অন্য কাউকে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী করা যেতে পারে কিনা? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, বাইডেন নিজে থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাইডেন যদি সরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবে সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, সম্ভবত না। সামনে দিনগুলোতে যাই হোক না কেন, প্রক্রিয়াটি যে জটিল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডেমোক্রেট ডেলিগেটরা যখন আগামী মাসেই (আগস্ট) তাদের কনভেনশনে একজন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে ভোট দেওয়ার জন্য সমবেত হবেন দলের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট হয়ে উঠবে।
বিতর্কের পরদিনই নিউইয়র্ক টাইমস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কঠোর সমালোচনা করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। “টু সার্ভ হিজ কান্ট্রি, প্রেসিডেন্ট শ্যুড লিভ দ্য রেইস” শিরোনামে এই নিবন্ধে পত্রিকাটি বাইডেনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তারা লিখেছে, ‘বৃহস্পতিবার রাতে প্রেসিডেন্ট একজন মহান জনসেবক বা সরকারি কর্মকর্তার ছায়া হিসেবে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি কি অর্জন করবেন তা তিনি ব্যখ্যা করতে পারেননি। তিনি ট্রাম্পের উস্কানিমূলক বক্তব্যের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাম্প যে মিথ্যাচার করেছেন, সেজন্য বাইডেন তাকে পাল্টা আক্রমণ করতে পারেননি।
ট্রাম্পের ব্যর্থতা এবং তার শীতল পরিকল্পনার জন্যও তিনি ট্রাম্পকে আক্রমণ করতে পারেননি। ট্রাম্প যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা বলতে চেষ্টা করেছেন, সেই পরিকল্পনা যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে দুর্বল করবে, এ ব্যাপারেও বাইডেন ট্রাম্পের ওপর আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া একাধিকবার এমন হয়েছে যে, বাইডেন কি বলতে চান তা শেষ করতে পারেননি। ২০২০ সালের নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নিয়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক নোংরা অধ্যায় সৃুিষ্ট করেছেন এবং ৬ জানুয়ারী ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করার জন্য তার সমর্থকদের উস্কানি দিয়ে যে ল্কংাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন সে ঘটনা তুলে ধরে বাইডেন ট্রাম্পকে আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস বরাবরই ডেমোক্রেট সমর্থিত সংবাদপত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কেবল একবার পত্রিকাটি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল। ২৭ জুন রাতের বিতর্কে বাইডেনের দুর্বল পারফরমেন্স নিউইয়র্ক টাইমসের পছন্দ হয়নি। বাইডেন-ট্রাম্প বিতর্কের পর সবগুলো মিডিয়ার জনমত জরিপে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে ৩-৪ পার্সেন্ট পয়েন্টে পিছিয়ে আছেন।
গত মঙ্গলবার সিএনএন এর ভিন্ন ধরনের জরিপ ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে ভোটারদের প্রশ্ন করা হয়েছে যে নভেম্বরের নির্বাচন যদি এ মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তারা কাকে ভোট দেবেন। উত্তরে ৪৯ শতাংশ ভোটার রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে এবং ৪৩ শতাংশ ভোট বাইডেনকে দেয়ার কথা বলেছেন। একই জরিপে বাইডেনের পরিবর্তে ডেমোক্রেট প্রার্থী ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গোভিন নিউসম প্রেসিডেন্ট হলে কাকে ভোট দেবেন প্রশ্নের উত্তরে ৪৮ শতাংশ ভোটার গভর্নর নিউসমকে এবং ৪৩ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে ভোট দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন।
নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর এখতিয়ার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের। তিনি যদি তা করেন, তাহলে ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে ডেলিগেটদের জন্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য ভোট দিতে পারবে। এটি হবে এক উন্মুক্ত কনভেনশন, যা আমেরিকার আধুনিক রাজনীতিতে এটি বিরল এক ঘটনা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি আসলেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাহলে তিনি তার সমর্থক ডেমোক্রেট প্রতিনিধিদের তার পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন করতে বাধ্যও করতে পারেন বলে নিউইয়র্ক টাইমস উল্লেখ করেছে। কিন্তু ডেলিগেটরা যদি একবার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাহলে তারা স্বাধীন। ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে যারা বাইডেনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন তাদের কাছে কিছু বিকল্প রয়েছে। যদিও বিকল্পগুলো কার্যকর হবে এমন সম্ভাবনা নেই। দলের সংহতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রার্থী মনোনয়নে যে জটিলতা সৃষ্টি হবে তা দলের আদর্শগত বিভাজনকে বৃদ্ধি করবে। ভবিষ্যৎ ডেমোক্রেট প্রার্থীর ক্যাম্পেইন দুর্বল হবে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ ইলেন কামারক মতে, মনোনয়নের ক্ষেত্রে অনুমানযোগ্য মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধা রয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস আরও বলেছে যে, বাইডেন যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী আধা ডজন ডেমোক্রেট প্রার্থী একজন হবেন, কিন্তু ডেমোক্রেটিক পার্টিতে তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ এবং তিনি প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন লাভের মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পাবেন না।
বাইডেন যদি তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন তাহলে কামালা হ্যারিস চাইলেও মনোনয়নে দ্বিতীয় অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবেন না। উল্লেখ্য আগামী ১৯ আগস্ট ডেমোক্রেটিক কনভেন শুরু হবে। কিন্তু পার্টি ৭ আগস্টের আগে একটি ভার্চুয়াল রোল কল করার নিয়ম অনুমোদন করেছে। মোট ৩,৯৩৪ জন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ডেলিগেট প্রথম ব্যালটে ভোট দেবেন। যদি একজন প্রার্থী ১,৯৬৮ এর সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন, তাহলে তিনি প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হবেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, বাইডেনকে সরে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হলে তা কি প্রতিরোধ করা উচিত? তাকে প্রতিস্থাপন করার জন্য তিনি একতরফাভাবে প্রার্থিতা থেকে সরে যেতে পারেন এমন কোনো উপায় আছে কি? এর উত্তর হলো, “কখনো বলো না যে কখনো নয়।” দলের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কিছু নড়বড়ে স্থান আছে বলে মনে হয়।
ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের সকল প্রতিনিধিরা তাদের সুবিবেচনা ও বিবেকে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন, যার মধ্য দিয়ে যারা তাকে ভোট দিয়েছেন, তাদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এটি ১৯৬৮ সালের ডেমোক্রেটিক পার্টি নয়, যখন নিয়মগুলি পার্টির কর্তাদের তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দান করতো। ওই সময়ের চেয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন আরও মুক্ত। ইলেন কামারক আরও বলেন, এখন সেই পুরানো দিন নয়। দলের নেতা বলে কিছু নেই।
মনোনয়ন কেড়ে নিতে পারে এমন ক্ষমতা সম্পন্ন লোকও নেই। প্রায় ৪,০০০ ডেলিগেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদি বলে যে, বাইডেনকে প্রার্থী করা উচিত নয়, এবং বাইডেনের চেয়ে ভালো প্রার্থী তাদের আছে, তাহলে বাইডেনের সম্মতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। যারা বাইডেনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন বলে বিবেচনা করা যেতে পারে, তাদের মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস ছাড়াও মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার, পেনসিলভেনিয়ার গভর্নর জোস শাপিরো, ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম; ইলিনয়ের গভর্নর জে,বি প্রিটজকার এবং কেনটাকির গভর্নর অ্যান্ডি বেশিয়ার। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য সম্ভাব্য প্রার্থী আছেন সেক্রেটারি অফ ট্রান্সপোর্টেশন পিট বুটিগিগ, মিনেসোটার সিনেটর অ্যামি ক্লোবুচার; এবং নিউ জার্সির সিনেটর কোরি বুকার।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদি কনভেনশনের পর তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন তাহলে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুসারে কমিটিকে নতুন প্রার্থী বাছাই করার ক্ষমতা দেওয়া হবে, যা নিয়ম ২০২২ সালের কনভেনশনে গৃহীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পার্টির ন্যাশনাল চেয়ারম্যান জেইম হ্যারিসন, কংগ্রেসে এবং ডেমোক্রেটিক গভর্নরস অ্যাসোসিয়েশনের ডেমোক্রেটিক নেতাদের সাথে পরামর্শ করবেন এবং ডেমোক্রেট ন্যাশনাল কনভেনশনে তাদের রিপোর্ট পেশ করবেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন স্বয়ং ডেলগেটরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ ভোটার বাইডেনের বিকল্প প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চান
আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬০ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিকল্প প্রার্থী চান। গত বৃহস্পতিবার বাইডেন ও ট্রাম্পের বিতর্কের পর মর্নিং কনসাল্ট প্রো পরিচালিত এক জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গত ২৮ জুন জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। মর্নিং কনসাল্ট প্রোর জরিপে বলা হয়েছে, যে ৬০ শতাংশ ভোটার বাইডেনের বিকল্প প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চান, তাঁরা দুই ভাগে বিভক্ত।
একাংশ ‘নিশ্চিতভাবে’ বাইডেনের বিকল্প চান। আরেকটা অংশ ‘সম্ভবত’ তাঁর বিকল্প হলে ভালো হবে—এমন মত দিয়েছেন। তবে এই দুই ভাগের মধ্যে কোনটি কত শতাংশ, তা জরিপের ফলে উল্লেখ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে এই জরিপ চালিয়েছে। এতে ২ হাজার ৬৮ নিবন্ধিত ভোটার অংশ নিয়েছেন। জরিপে দেখা যায়, বৃহস্পতিবারের বিতর্কটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের ৫৭ শতাংশ মনে করেন, বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প বিতর্কে ভালো করেছেন। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক, ৬০ শতাংশ নিরপেক্ষ এবং বাকিরা রিপাবলিকান।
জরিপে অংশগ্রহণকরী ২১ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পদ থেকে সরানো ‘অবশ্যই উচিত নয়’ বলে মত দিয়েছেন। আর ২০ শতাংশ বলেছেন, তাঁকে সরানো ‘সম্ভবত উচিত নয়’। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে আরেকটি প্রশ্ন ছিল, তাঁরা কাকে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান? এ প্রশ্নের জবাবে ৪৫ শতাংশ বাইডেনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেয়েছেন। আর ৪৪ শতাংশ চেয়েছেন ট্রাম্পকে। বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারের মুখপাত্র সেথ শুস্টার মর্নিং কনসাল্টের জরিপ ফল উপস্থাপনার (ফ্রেমিং) সমালোচনা করেছেন। বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার পদ থেকে সরবেন না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।