নর্থ আমেরিকার বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন হল ফোবানা। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফোবানার সম্মেলনগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতি বছর ফোবানার অনুষ্ঠানে এখানকার কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের আমন্ত্রণ জানানো হয় বলে জানান মীর চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেটে ছড়িয়ে থাকা ফোবানার অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সাথে আমাদের নতুন প্রজন্ম সম্পৃক্ত হবে, এটাই আমার চাওয়া। আমি চাই, তারা ফোবানাকে মূল ধারার রাজনীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিক। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের মাধ্যমে ফোবানাতে একটা শান্তিময় পরিবেশের সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
গেল বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সম্প্রচার ‘টক অফ দ্য উইক’ অনুষ্ঠানে আগামীর ফোবানা সম্পর্কে এভাবেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন কমিউনিটির বহুমুখি সচেতনমূলক কাজের জন্য পরিচিত ও প্রসংশিত মীর চৌধুরী।
মীর চৌধুরী, পেশায় ট্যাক্স অ্যাডভাইজর ও সিনিয়র ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ফোবানার জন্মলগ্ন থেকেই মীর চৌধুরী এর সাথে জড়িত। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তিনি ফোবানার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তিনি পুনরায় ফোবানা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়াও, মীর চৌধুরী ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সোসাইটির সদস্য হিসাবে বাংলাদেশি সংগঠনের যাএা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ জার্সির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন ও ২০০০ সালে ওই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। মীর চৌধুরী আমেরিকা বাংলাদেশ এডুকেশন ফান্ডের একজন উপদেষ্টা, যা বাংলাদেশের মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তায় কাজ করে থাকে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ৭১’-এর মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের সব বীর যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু করেন উপস্থাপিকা সোহানা নাজনীন।
ফোবানা সম্পর্কিত ও নানা প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন মীর চোধুরী। শুরুতেই তিনি প্রবাসী বাঙ্গালিদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে থাকাকালীন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম, চট্রগ্রামের বিখ্যাত নাট্যগোষ্ঠীর সাথেও কাজ করেছি। আমার কোন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নেই, সামাজিক প্রেক্ষাপটেই থেকেছি এ পর্যন্ত। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন নিউ জার্সির বাঙালি সংগঠনের সাথে জড়িত হই। ১৯৮৭ সালে উত্তর আমেরিকার ওয়াশিংটনে প্রথম ফোবানা সংগঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্কে ফোবানার দ্বিতীয় কনভেনশনের সাথে জড়িত হয়ে আজ পর্যন্ত আছি। সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের খুব কাছাকছি থেকে কাজ করার সুবাদে আমি ভাল বোধ করি। ছোটবেলা থেকেই সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতি আগ্রহ ছিল, এ দেশে আসার পরেও সেটা অব্যাহত রেখেছি।’
এরপর ফোবানার সাথে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের প্রেক্ষাপট জানতে চান সোহানা নাজনীন।
মীর চোধুরী বলেন, ‘ফোবানার আগেই আমি নিউ জার্সির বাঙালি সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। ফোবানা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে উত্তর আমেরিকার বাঙালি সংগঠনের সবাই বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনে জমায়েত হন। এতে করে একটা পারিবারিক বন্ধন তৈরি হয়, এই ব্যাপারটা আমাকে প্রভাবিত করেছিল। ফোবানার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বাঙালিদের সাথে পরিচিত হতাম। আমার কাছে ফোবানা একটা মিলনমেলা। এটা নিয়ে কাজের মাধ্যমে বৃহৎ আকারে আরো এগিয়ে নেবার চিন্তা ভাবনা আমার ভিতরে কাজ করে।’
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের ঐক্য আর সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তিন দশক আগে ফোবানা সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, অনেকেই মনে করছেন, নেতৃত্ব আর দখলদারির কবলে পড়ে জৌলুশ হারাচ্ছে ফোবানা। একই নামে আমেরিকার একাধিক শহরে ফোবানা সম্মেলন হয়। এ প্রসঙ্গে মীর চৌধুরী অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানান, মানুষ দশ বছর আগে যে ফোবানাকে সম্মান দেখাত, সেই ফোবানা আর নেই। ফোবানা থেকে ২০২২ সালে কিছু মানুষ বের হয়ে নতুন ফোবানা তৈরি করেছে বলেই এমনটা।
তিনি বলেন, ‘ফোবানা কোন ব্যাক্তিগত সংগঠন নয়। বরং, এটি সংগঠনের সংগঠন। উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে ৬০-৭০টা সংগঠন মহৎ কাজের লক্ষ্য নিয়েই প্রথমদিকে ফোবানা গঠিন করেছিল। ফোবানার মাধ্যমে শুধু প্রবাসে থাকা বাঙালিরা একসাথে মিলিত হওয়া নয় বরং বাংলাদেশের জন্যে কিছু করতে চেয়েছিলাম। মূলধারায় রাজনীতির মাধ্যমে কিছু সাহায্য পাব এই উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু করেছিলাম। কিন্তু, ক্রমান্বয়ে এর পরিধি বাড়তে থাকলেও দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে অনিয়ম শুরু হয়। কে নেতৃত্ব দেবে, কে কি কাজ করবে- এই নিয়ে নানা মতভেদ দেখা দেয়। মতামত, চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ফোবানা নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি আমরা।’
ফোবানার বা অন্যান্য কাজের বাইরে মীর চৌধুরী তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনাস-মাস্টার্স পাশের পর ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এ দেশে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এবং একাউন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করে প্রথম চাকরি করেছিলেন হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সে। ট্যাক্সেশনের উপরে ভাল অভিজ্ঞতা থাকায় ২০১৫ সালের পর থেকে নিজের ট্যাক্সেশন ব্যবসায়ের সাথেই নিয়োজিত আছেন।
মীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে হিউস্টন অ্যাকর্ডের পেছনের গল্পটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ব্যাপারটা আমাকে সব সময় উৎসাহিত করে, গর্বিত করে। ১৯৮৮’র পর ফোবানা দ্বিতীয় বারের মত ভেঙ্গে গেলে আমরা দুইটা ফোবানা একটা প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাই। বিপক্ষীয় কিছু নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে ২০১৩ সালে আমরা সবাই একটা পরিবারে মিলিত হই। সেই একত্রিত হবার পিছনে আমার পরিশ্রম ও নেতৃত্ব ছিল। সেই থেকে আবারো আমাদের পথচলা শুরু হয়। কিন্তু, আবারো ২০২২ সালে কিছু বন্ধুবান্ধব বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে গেছেন।’
মীর চৌধুরী পেশাগত জীবনের পাশাপাশি কমিউনিটির বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করেন। এসব করতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন কিছু চ্যালেঞ্জের। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সোসাইটি অফ নিউজার্সির সাথে যুক্ত হবার মাধ্যমেই আমার উত্তরণ। কোভিডের সময় আমরা নির্ভীকভাবে ঘরে ঘরে ফোবানা সংগঠনের মাধ্যমে সাহায্য করেছিলাম। কমিউনিটির মানুষকে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সাহায্য, ফান্ডের মাধ্যমে টাকা তুলে কন্স্যুলেটের মাধ্যমে দেশে বন্যা কবলিত মানুষদেরকে সাহায্য করেছিলাম। এই কাজগুলো করতে যেয়েই আমার ভিতরে উৎসাহ বেড়েছে, মানুষের প্রতি ভালবাসা জন্মেছে। তবে, এসব কাজে কখনো সমালোচনায়ও পড়তে হয়। মানুষের ভিন্ন মত থাকবেই। কেউ ভাল কাজগুলোতে মন্দ কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। কেউ বাধা দিবেন। কিন্তু, আমাদের কাজ হল ভাল কিছু করার চেষ্টা করে যাওয়া।’
বাংলাদেশ এডুকেশন ফান্ডের একজন উপদেষ্টা হিসাবে ফান্ডের কাজগুলো কীভাবে হয়, কারা এতে সম্পৃক্ত ও বিষয়টি কী আরো বৃহৎ পরিসরে নেওয়ার কোন প্লান আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগে কিছু বন্ধুর সাথে এই সংগঠন শুরু করি। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন আমার স্ত্রী, আমি একজন সিনিয়র এডভাইজার। আমাদের দেশে বহু গরিব মেধাবী ছাত্র অর্থের কারণে পড়াশোনা করতে পারে না। যাদের জিপিএ ভাল তাদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তার মাধ্যমে পরবর্তী পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেই। প্রথম দিকে ১৫-২০ জন ছাত্রকে সাহায্য করেছিলাম, পরে অনেকের কাছ থেকে সাধুবাদ পাই। অনেকেই ডোনেট করেছেন, আমাদের ফান্ড বেড়েছে। এই সংগঠনকে বৃহৎ আকারে নেওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি। গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ জন মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশে আমাদের কিছু কো-অর্ডিনেটর কাজ করে, তাদের কাছে জিপিএ ৩.৫’-এর উপরে পাওয়া ছাত্রদের মার্কশিট, হেড অফ দ্যা ইন্সটিটিউশন থেকে পরিচিতিসহ একটা সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। সেগুলো ইমেইলের মাধ্যমে পাবার পর বিবেচিত ছাত্রদের যাচাই বাছাই করে স্কলারশিপ দেয়া হয়।’
‘আমেরিকা-বাংলাদেশ এডুকেশন ফান্ড নামের ওয়েবসাইটে সব প্রক্রিয়া উল্লেখ আছে।’
মীর চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক সহায়কমূলক অনেক কিছুই করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি চেষ্টা করি, নিজ গ্রামঞ্চলের মানুষদেরকে বার্ষিক কিংবা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে সাহায্য করতে। গরির আত্মীয়দের বাড়ি করে দিয়েছি, কাউকে ব্যবসায় করার পুঁজি দিয়েছি, স্কুলে-মসজিদ-মাদ্রাসায় খাবার, বিদ্যুৎ বিল দেয়ার চেষ্টা করি।’
মীর চৌধুরী মনে করেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের কমিউনিটি সচেতনতায় আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত। প্রবাসী বাঙালিরা এ দেশের মূলধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যেমন ব্যাক্তিগতভাবে উপকৃত হবেন, তেমনি আমাদের দেশও উপকৃত হবে। তাছাড়া, এ দেশের প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, এ দেশকে ভালবাসতে হবে।’
বরাবরের মতই কারিগরি সহযোগিতায় থাকা এইচবি রিতা প্রশ্ন করেন, বহু সময় কমিউনিটির কাজগুলো করতে গিয়ে কিছু বাঙালিদের কটূক্তিমূলক ও সন্দেহমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। আমরা যারা কমিউনিটিতে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, তারা আসলে কিভাবে বাংলাদেশের দুঃস্থদের সেবায় নিজেদেরকে একত্রিত করে কাজ করতে পারি?
মীর চৌধুরী জানান, ‘বাঙালিদের সবার মানসিকতা এক নয়। সমষ্টিগতভাবে কাজ করলে এই আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক সাহায্য সম্ভব। তবে নানাজনের নানা মতের কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আর তাতেই আসল উদ্দেশ্য থেকে আমরা সরে যাই। নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং ভাল কিছুর উদ্দেশ্যে কাজ করে যেতে হবে।’
নানা রকম সামাজিক সংগঠনমূলক কাজের আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ করেন সোহানা নাজনীন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার ‘টক অফ দ্য উইক’ অনুষ্ঠানটি প্রতি বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় রাত নয়টায় ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।