মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব, বেকারত্ব- সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যে ভালো নেই বাংলাদেশিরা। এ কমিউনিটির প্রায় ১২ লাখ মানুষের বেশিরভাগ এখন বেড়ে যাওয়া ব্যয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ। মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাড়ির ব্যাংক মর্টগেজের মাসিক কিস্তি দ্বিগুণ হয়েছে অনেকের। গত দুই বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পুরোনো বাংলাদেশিরাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে গত তিন বছরে স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ও কেয়ার ভিসায় আসা বাংলাদেশিরা পার করছেন চরম দুঃসময়। বিশেষ করে লন্ডনে আবাসন সংকটে নাকাল কর্মহীন বেকার অবস্থায় বহু বাংলাদেশি। অনেকের থাকার জায়গা নেই। এই কমিউনিটির মানুষদের কর্মসংস্থানের প্রধান খাতগুলো করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ বাড়লেও কাজের সুযোগ সমানুতিকভাবে বৃদ্ধি না পাওয়াকেও এমন পরিস্থিতির জন্য একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে বাড়ি ভাড়া ৫ দশমিক ১ শতাংশ বাড়লেও বাস্তবে এ হার অনেক বেশি। লিখিত চুক্তিপত্র ছাড়া নতুন অভিবাসীদের ঘর ভাড়া দেওয়া মালিকরা আদায় করছেন ইচ্ছেমতো ভাড়া। কেয়ার ভিসা, ওয়ার্ক পারমিটে আসা বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্তত কয়েক হাজার মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত কাজ পাচ্ছেন না আসার পর থেকেই।
আমাদের মৌলভীবাজার ইউকে’র সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম বলেন, নতুনদের পাশাপাশি পুরনোরাও বিপাকে। বর্তমান সময়ে যে সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করছে সেটি হচ্ছে বাসস্থান। আগে যেখানে একটি ডাবল রুমের সর্বোচ্চ ভাড়া ৪০০ পাউন্ড ছিল সেটি এখন হাজার পাউন্ডে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে একটা ঘর কিংবা রুম সহজেই পাওয়া যেত এখন সেটা হয়ে গেছে সোনার হরিণ। নতুনরা থাকার সুবিধার জন্য শহর পরিবর্তন করতে পারলেও পুরাতনরা সেটি করতে পারছেন না।
ব্রিটেনের সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষক নুরুর রহিম নোমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যের ধরণ ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা মন্দা যাওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করে অর্ধেক দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের তেমন সমস্যা না হলেও জটিলতায় পড়ছে ছাঁটাই হওয়া কর্মীর পরিবার। কেননা হয়তো চাকুরি হারানো সেই মানুষটাই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। করোনার লকডাউনে মানুষের মধ্যে যে অনলাইন নির্ভরতার অভ্যাস সৃষ্টি হয়েছিল সেটির প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হসপিটালিটি খাত। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কারি শিল্পে বেশি প্রভাব পড়েছে। রেস্তোরাঁগুলোতে ব্যবসা কমেছে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে যুক্ত আছেন মিনিক্যাব ইন্ড্রাস্ট্রিতে। কয়েক লাখ বাংলাদেশি এই ক্যাব চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এ সেক্টরেও আয় কমেছে।
ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম খছরু বলেন, ব্রিটেনে অভিবাসী বাংলাদেশিদের মূল পেশা ট্যাক্সি চালানো, রেস্তোরাঁ, হসপিটালিটি ও কেয়ারিং খাত। বদলে যাওয়া বাস্তবতায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে বর্তমান অথনৈতিক সংকটে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
বেডফোর্ডে বসবাসরত সাংবাদিক ও কমিউনিটি নেতা সায়েকুল হক সায়েক বলেন, ব্রিটেনে বাঙালির মূল ব্যবসা এখনও রেস্তোরাঁ। নানা কারণে টার্কিশ, মরোক্কান, চাইনিজ খাবারের সঙ্গে আমাদের রেস্তোরাঁগুলো মান ও দামের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। চেইন সুপারমার্কেটগুলোতে ভাত-তরকারির বিক্রি কমে গেছে। দক্ষ শেফের অভাব রয়েছে এ সেক্টরে।
লুটনে বসবাসরত সমাজকর্মী ও লেখক মাহবুবুল করীম সুয়েদ বলেন, মানুষের হাতে নগদ অর্থ নেই। সঞ্চয় ভেঙ্গে অনেকে চলছেন। ব্রিটেনে বাইসাইকেল থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি, ফোন ছিনতাই অতীতের তুলনায় বেড়েছে কয়েকগুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফয়সল রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনার সময়ে এদেশে বড় বড় কোম্পানিগুলো কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করিয়ে দেখেছে কোনও সমস্যা হয় না। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কোম্পানিগুলো এ পথেই ঝুঁকছে। কম কর্মী দিয়ে কাজ করিয়ে সুপারস্টোরগুলো দেখেছে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এ ধারা চলমান থাকায় ব্রিটেনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।
লন্ডনে শিক্ষকতা, সম্পাদনা ও সাংবাদিকতা পেশায় গত ৪২ বছর ধরে যুক্ত থাকা ড. রেনু লুৎফা বলেন, অভাব-অনটন, কাজ না থাকা মানুষের জীবনে নতুন কিছু নয়। ব্রিটেনের মানুষ বারবার এই সব প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিভিন্ন মহামারির পর লড়াকু মানুষ নতুন উদ্যমে জীবন গড়েছে। নতুন জীবিকা তৈরি করেছে। সদ্য আসা বাংলাদেশিদেরও নতুন জীবিকার পথ বের করতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ক্যাটারিং ব্যবসার নতুন সংস্করণ আনতে হবে। নতুন পেশার দিগন্ত খুঁজে বের করতে পারলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।