সংঘবদ্ধ চক্রের সীমাহীন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির হাজার হাজার মানুষ। মানুষের সচেতনতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন লোভনীয় প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারকরা সর্বস্বান্ত করছে তাদের। নতুন আসা অভিবাসীদের কারণে ভাড়ায় বাড়ি ও রুমের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় আবাসন নিয়ে প্রতারণা এখন বহুগুণ বেড়ে গেছে। সঙ্গে রয়েছে বেশি মজুরিতে কাজ পাইয়ে দেওয়া, ভিসার রুট পরিবর্তনের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা।
কমিউনিটির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বসবাসের অযোগ্য স্থানকে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরে নতুন আসা অভিবাসীদের কাছে ভাড়া দেওয়ার নামে চুক্তি করে জামানত নিয়ে লাপাত্তা হওয়া, ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে ফেসবুকে পেজ ও অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিরাপত্তা জামানতের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। যারা স্টুডেন্ট ভিসায় এসে ওয়ার্ক পারমিট বা কেয়ার ভিসায় ভিসার রুট পরিবর্তন করতে চান তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার পাউন্ড নিয়ে কাজ করে দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে কমিউনিটিতে। এসব নিয়ে সামাজিকভাবে বিচার শালিসও চলছে।
আরও রয়েছে হলিডে প্যাকেজ, এয়ার লাইন্সগুলোর সস্তা দামে টিকিট দেওয়ার নামে বিভিন্ন ভুয়া ওয়েবসাইট চালু করেও অর্থ নিচ্ছে প্রতারকরা। ট্যাক্স রিফান্ড দেওয়ার নামে মোবাইলে সরকারি ওয়েবসাইট ও ফোন নম্বর ক্লোন করে মেসেজ পাঠিয়ে কৌশলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করে ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অর্থ। সস্তায় নতুন মডেলের মোবাইল ফোন বিক্রির নামে চলছে প্রতারণা। এছাড়া মানুষের নাম পরিচয়, ঠিকানা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য ব্যবহার করে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন। প্রতারিত ব্যক্তির ঠিকানায় মাস শেষে যখন বিল আসছে কেবল তখন তারা প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারছেন।
এছাড়া হালাল বিনিয়োগ, বিনিয়োগকৃত অর্থ নিরাপদে বিমাকৃত থাকবে, বিটকয়েন ফোরেক্সসহ বিভিন্ন ব্যবসার নামে গত তিন বছরে হাবিব সন্স ক্যাপিটালসহ কয়েকটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুতদের প্রতারক চক্র শত শত মানুষের বাড়ি-ঘর বিক্রির টাকা থেকে শুরু করে সঞ্চয় লুটে নিয়েছে।
এক সমীক্ষা অনুসারে, ব্রিটেনে অনলাইনে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা এই বছরের প্রথমার্ধে এক-পঞ্চমাংশ বেড়েছে। ইউকে ফাইন্যান্সের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় অনুমোদিত পুশ পেমেন্ট (এপিপি) জালিয়াতি ২২ শতাংশ বেড়েছে।
সেলিম মিয়া, সৈয়দ ময়নুল হকসহ বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী এই প্রতিবেদককে জানান, মার্কেট প্লেস, স্পেয়ার রুমসহ বিভিন্ন বসবাসের অযোগ্য স্থানকে অনলাইনে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরে কম টাকায় ভাড়া দেওয়ার কথা বলে প্রতারকরা। শুরুতেই তারা আগ্রহীদের সঙ্গে একটি ভুয়া বাড়ি ভাড়ার চুক্তি করে নেয়। চুক্তির পর জামানত ও প্রথম মাসের ভাড়া নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে। এরপর মালিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি ফোন বন্ধ করে দেন। পরে খোঁজ নিয়ে ভুক্তভোগীরা জানতে পারেন ভুয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তারা। অনেক সময় ভাড়াটিয়া ঘরে প্রবেশের দিন মালপত্র নিয়ে এসে দেখতে পান যার সঙ্গ চুক্তি হয়েছে তিনি ভুয়া, প্রকৃত মালিক অন্য কেউ। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে সাবলেট রুম ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে নতুন আসা মানুষদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন হয়রানি করছেন।
সেলিনা বেগম নামের একজন জানান, দেশ থেকে নতুন যারা যুক্তরাজ্যে আসেন তারা মনে করেন লন্ডনের বাইরে কাজ নেই। প্রায় সবাই বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে থাকতে চান। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি ডাবল রুমের ভাড়া দ্বিগুণ নেওয়া হচ্ছে। দুই বছর আগে এই ভাড়া ছিল ৫০০ পাউন্ড। অথচ এখন তা ১০০০ থেকে ১১০০ পাউন্ড আদায় করা হচ্ছে।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক চিফ হুইপ ও কাউন্সিলার সুনাওর আলী ট্রিবিউনকে বলেন, সংঘবদ্ধ প্রতারকদের পাশাপাশি আবাসন সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, দেশ থেকে নতুন আসা মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে বিনা চুক্তিতে রুম ভাড়া দিয়ে অমানবিক আচরণ করছেন মালিকরা। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল বাঁচাতে সপ্তাহে একদিন বা দুদিনের বেশি রান্না ও ওয়াশিংমেশিন ব্যবহার করতে না দেওয়া, এমনকি দুই দিনের বেশি গোসলও করতে দিচ্ছেন না অনেক মালিক- এমন অসংখ্য অভিযোগ আমরা পাচ্ছি।
সবাইকে নতুন আসা অভিবাসীদের প্রতি মানবিক আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।