ভারতের দুর্গাপূজার মণ্ডপে ট্রাম্প ‘অসুর’ রূপে—কেন এমন প্রতীকী উপস্থাপন?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৫১

সিংহের পিঠে বসে আছেন দেবী দুর্গা। তাঁর দশটি হাতে দেবলোকে পাওয়া অস্ত্র ঝলমল করছে। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য সেই চিরচেনা মহিষাসুর নয়; তিনি নিশানা করেছেন এক ভিন্নরূপের ‘অসুরকে’, যাকে অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেই মূর্তির মাথায় সোনালি চুল, শরীর সুঠাম, আর মুখের অবয়ব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো।
গত সপ্তাহে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা উৎসবের সময় অসুররূপী এই ভাস্কর্যটি উন্মোচন করা হয়। এটির প্রতীকী বার্তা উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল।
মুর্শিদাবাদের দুর্গাপূজা আয়োজক কমিটির সদস্য সঞ্জয় বসাক সিএনএনকে বলেন, ‘আগে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো ছিল। তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতকে চেপে ধরার, আমাদের নিচে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে। তাই আমরা ট্রাম্পকে এই অসুর হিসেবে দেখিয়েছি, যাকে পরাস্ত করেছেন শক্তিশালী মা দুর্গা।’
পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গাপূজা উৎসব চলাকালে পুরো শহর যেন খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত শিল্প প্রদর্শনীর মতো হয়ে ওঠে। এখানে দেবী দুর্গা এবং তাঁর অসুরের পৌরাণিক লড়াইকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক উদ্বেগ ও নানা সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে ভারতে দুর্গাপূজার মণ্ডপগুলোর মধ্য দিয়ে অভিবাসী সংকট থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ—নানা বিষয়কে তুলে ধরতে দেখা গেছে।
বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিল তৈরি করে থাকেন সুশোভন সিরকার। নয়াদিল্লি ও কলকাতায় আসা-যাওয়া করেন তিনি। সুশোভন বলেন, ৯/১১-এর পর ওসামা বিন লাদেন একটি জনপ্রিয় বিষয় ছিল।
২০২০ সালে ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্তে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পরে একটি মণ্ডপে চীনের নেতা সি চিন পিংকে খলনায়কের ভূমিকায় দেখিয়েছিল। আর সে ধারা বজায় রেখে এবার একটি মণ্ডপে ট্রাম্পকে অসুর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
পরিস্থিতি সব সময়ই এমন ছিল না
ছয় বছর আগে ট্রাম্প হিউস্টনের এনআরজি স্টেডিয়ামে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে হাত ধরে র‍্যালি করেছেন। সেখানে উপস্থিত থাকা ৫০ হাজার মানুষ এ দুই ডানপন্থী নেতাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।
সে র‍্যালি ‘হাউডি মোদি!’ নামে পরিচিত। এরপর গুজরাটের আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।
তবে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের বন্ধুত্ব পরীক্ষার মুখে পড়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে ট্রাম্প জনসমক্ষে নয়াদিল্লিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। দেশটির পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক (৫০ শতাংশ) আরোপ করেছেন।
ওই ৫০ শতাংশ শুল্কের অর্ধেকই আরোপ করা হয়েছে শাস্তিস্বরূপ। ইউক্রেনে রুশ হামলার পরও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বাড়িয়ে দেওয়ায় ট্রাম্প ওই উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন।
ভারত ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘অন্যায়’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এখনো রাশিয়ার সঙ্গে সার ও রাসায়নিক পণ্যের বাণিজ্য চালাচ্ছে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আগস্টে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা রাশিয়ার যুদ্ধকে ‘মোদির যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। ক্রেমলিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কমানোর জন্য নয়াদিল্লির ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে।
ভারত বারবার রাশিয়ার তেল কেনার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। সমর্থন করেছে এবং এই মন্তব্যকে ‘ভুল ও বিভ্রান্তিকর’ বলেছে।
এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসে ট্রাম্প হঠাৎ করে এইচ-১বি ভিসার জন্য এক লাখ ডলারের ফি আরোপের নির্দেশ দেন। অনেকে এটাকে ভারতীয়দের নিশানা করে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, ভারতীয়রা এই এইচ-১বি কর্মসূচির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলেন।
কলকাতার বাসিন্দা তুনির মুখার্জি বলেন, ‘ট্রাম্পকে মহিষাসুর হিসেবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মণ্ডপ পরিদর্শনকারী মানুষ এবং এটি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা গণমাধ্যমের কাছে একটি রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে।’
তুনির মুখার্জির মতে, শিল্প ও রাজনীতির এই মিশ্রণ বাঙালি সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। এটি একটি সরল কিন্তু শক্তিশালী বার্তা দেয়। সেটি হলো ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ‘অনগ্রসর নীতি’ আধুনিক যুগের অসুর হয়ে উঠেছে। দেবী মা দুর্গাকেই এই অসুর বধ করতে হবে।
যে পূজামণ্ডপে ট্রাম্পকে অসুর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানকার আয়োজক কমিটির সদস্য সঞ্জয় বসাক বলেছেন, তাঁদের দলটি তিন মাস ধরে প্রায় সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজ করেছে। মণ্ডপ উন্মোচনের আগে আকর্ষণ তৈরির জন্য জেনেশুনে এমনটা করা হয়েছে।
মণ্ডপ উন্মোচন করার পর ভিডিওটি অনলাইনে প্রকাশ পেলে চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বসাক বলেন, হাজার হাজার মানুষ মণ্ডপে ভিড় করেছিল, চারপাশের এলাকায় মানুষের লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদের ঐতিহ্য
পশ্চিমবঙ্গে শিল্প কখনো কেবল শোভা বা সাজসজ্জার বিষয় ছিল না। বরং এটি সংলাপের ভাষা, প্রতিবাদের একটি হাতিয়ার, এমনকি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের প্রধান মাধ্যম।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা অস্ত্রের মাধ্যমে লড়াই হয়েছিল, ততটাই চিন্তা ও আইডিয়ার মাধ্যমে।
কবি ও ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭০-এর দশকে ‘বন্দে মাতরম’ কবিতা রচনা করেন, যা পরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা লাভের পর এই গভীর রাজনৈতিক চেতনাবোধ শেষ হয়ে যায়নি। স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির ৩০ বছরেরও বেশি শাসনকালে এটির আরও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে দুর্গাপূজা এখন কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি জনসংলাপ ও সামাজিক-রাজনৈতিক সমালোচনার একটি মাধ্যমও।
ট্রাম্পের মূর্তি তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আয়োজক কমিটির সদস্য বসাক বলেন, ‘এ ধরনের সমালোচনা আমাদের সংস্কৃতির অংশ।’
বসাকের মতে, ট্রাম্প ক্রমাগত শুল্ক আরোপ করছেন, এটিই এখনকার বড় সমস্যা। আর, তাই এটিকে এভাবে উপস্থাপন করাটাই যৌক্তিক।