নব্বই/একানব্বই সালের কথা। ঢাকায় এসে গ্রাসাচ্ছাদনের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করেছি।
ভালো চাকরির স্বপ্ন মাথায়। কিন্তু লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনাটিই তীব্রতর। কবিতা ছাড়াও ছোট গল্প ও আলোচনামূলক গদ্য বেরোচ্ছে নানা পত্রিকায়।
ওই সময় আমার পিতা একবার ঢাকায় আসেন। আমি-যে নিয়মিত লেখালেখি করি এবং এই পথে নিজেকে শক্তভাবে দাঁড় করাতে চাই, এটা তিনি জানতেন। আমার কিছু লেখা, ততদিনে, তিনি পড়েও ফেলেছিলেন।
একদিন, মধ্যাহ্নভাজের পর, আমাকে বললেন, ‘দ্যাখ রে বাবা। তোর যে বয়স সে হিসেবে তুই খারাপ লিখিস না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, বয়স্ক পাঠকের সাহিত্য রচনা করতে না পারলে কোনো লাভ হবে না।’
সেই থেকে ওই ‘বয়স্ক পাঠকের, সাহিত্য’ কথাটা আমার কানে লেগে আছে। প্রধানত তিনটি কারণে পিতার ওই পরামর্শকে শিরোধার্য করেছিলাম।
১. আমার পিতা সে আমলের কলেজে-পড়া মানুষ যখন এমনকি ম্যাট্রিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট থাকলেই মোটামুটি সম্মানজনক সরকারি চাকরি জুটত।
২. ইংরেজি ভাষাটা তিনি ভালোই জানতেন এবং দেশি-বিদেশি সাহিত্য (বিশেষ করে উপন্যাস প্রবন্ধ) পড়তে দেখতাম তাকে। স্পষ্ট মনে আছে, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি,’ সমরেশ বসুর ‘বাঘিনী’, আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈল চিত্র’ এবং শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ বইগুলো রাত জেগে তাকে পড়তে দেখেছি নিবিষ্ট মনে।
৩. সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম আমরা। বাসায় আসবাবপত্র, দরজা-জানালার পর্দা থেকে শুরু করে জামা-জুতা-চশমার ফ্রেম, শাড়ির রং সব কিছুতেই তার উন্নত রুচির প্রকাশ লক্ষ করেছি আমি। এখন বুঝতে পারি, পিতার সেই উপদেশ মান্য করে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হইনি, বরং উপকৃতই হয়েছি। শৈশব থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে রূপকথা ও বিখ্যাত মানুষদের জীবন কাহিনীভিত্তিক অনেক বই এনে দিতেন বাবা।
সাধারণ জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বইও আনতেন মাঝে মাঝে। অল্প কিছু দিনের ভেতর ওগুলো পড়ে শেষ করতাম আমি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একটা পদ্য লিখেছিলাম ‘সকাল’ নামে।
সেটিই প্রথম প্রচেষ্টা। তারপর কলেজের দু’বছরে নিজ হাতে সেলাই করা সম্পূর্ণ শাদা পৃষ্ঠার একটা খাতা প্রায় ভরে ফেলেছিলাম পদ্য লিখে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার ওই পাঠাভ্যাস নেশায় পরিণত হল।
তারও বছর দশেক পর অনুধাবন করি, কেবল পড়লেই হবে না, নবীন লেখক হিসেবে নিজেকে এগিয়ে নিতে হলে, ‘বয়স্ক পাঠকের সাহিত্য’ রচনা করতে হলে আমাকে বেশি করে পাঠ করতে হবে দেশ-বিদেশের সেই সব প্রবীণ লেখকের বই-পত্র যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান।
বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকগণ, আশা করি, বুঝতে পেরেছেন; ‘বয়স্ক পাঠক’ বলতে আমি এখানে নিছক বয়সের ভারে ক্লান্ত ব্যক্তিদের বোঝাচ্ছি না, বরং বলছি তাদের কথা যারা অল্প বয়স থেকেই মানসম্পন্ন বইপুস্তক পড়ে রুচিকে উন্নত করেছেন এবং যাদের আছে গ্রন্থের ভালো-মন্দ বিচারের সহজাত প্রতিভা।
সেই শ্রদ্ধেয়জনদের রুচির উপযুক্ত সাহিত্য লেখার জন্য বড় রকম প্রস্তুতি প্রয়োজন। জীবনবৈচিত্র্যে ভরপুর। প্রতিটি মানুষের জীবনেই গল্প আছে। প্রত্যেকটি গল্পই কি সাহিত্যের উপযোগী?
অজস চরিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকটিকে আমরা তুলে আনি গল্পে, উপন্যাসে। Skating and Other observations নামের একটি কাব্যগ্রন্থ পড়েছিলম বহু আগে। সেই থেকে পর্যবেক্ষণ (Observation) বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিই।
ভাবি, আমার জীবনাভিজ্ঞতার কোন কোন অংশ বেশি আলোকিত; জীবনের কোন ঘটনাগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে। লেখার আগে আমাকে ভাবতে হয় কোনগুলো নেব, কোনগুলো বাদ দেব। যেগুলো নেব আমার রচনা বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাদের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি?
যদি প্রতীকের ব্যবহার প্রয়োজনীয় মনে হয় তাহলে কোথা থেকে নেব তাদের আর কী অর্থেই বা সেগুলো প্রযুক্ত হবে? বিষ্ণুদে’র একটি প্রবন্ধগ্রন্থ আছে। নাম ‘রুচি ও প্রগতি।’
বইটি আমি প্রথম পড়ি তিরিশ বছর আগে। এটা সেই গল্প কিছু বইয়ের একটি যেগুলোর নাম আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে ‘প্রগতি’ শব্দটির প্রয়োগ।
সত্যিই তো, জীবনে সুরুচি অর্জন করতে না পারলে সুলিখিত সাহিত্যগ্রন্থও রচনা করা সম্ভব হয় না। সাহিত্যিকের সাধনা, অতএব, সুরুচি অর্জনের সাধনা।
পাঠকেরও কিছু চেষ্টা থাকা দরকার। দরকার খোঁজখবর রাখারও। গত একশ বছরের শিল্প-সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে যদি মোটামুটি ধারণাও থাকে তাহলে আশা করা যায় সেই পাঠক নতুন ধাঁচের সাহিত্যকে কম-বেশি সমর্থন করবেন। তা নাহলে হবে কি, তিনি হয়তো শামসুর রাহমানের কবিতা পছন্দ করেন, কিন্তু আব্দুল মান্নান সৈয়দের বা মুস্তফা আনোয়ারের কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। ওয়ালীউল্লাহ ‘লাল সালু’ তার ভালো লাগবে অথচ একই লেখকের ‘কাঁদো নদী কাঁদো’কে মনে হবে পাগলের প্রলাপ।
জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রে উন্নত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন এমন মনুষও আধুনিক কবিতা বা উপন্যাস না-ও পড়তে পারেন যদি তার সাহিত্য পাঠেরই অভ্যাস না থাকে। রুচির ব্যাপারটাও তাই বিচিত্র ও ভাবনা উদ্দীপক।
আমি খেয়াল করে দেখেছি, অসংখ্য লেখকের পঁচিশ বছরের লেখার আর পঞ্চাশ বছরের লেখার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। আমার
প্রজন্মেরও অনেকের মধ্যেই এমনটা দেখা গেছে। এদের আমার সুইফটবর্ণিত লিলিপুটের মতো মনে হয় যারা ছ’ইঞ্চির বেশি কিছুতেই বাড়ে না। এ লেখকরা অর্বাচীন আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন এবং আত্মতুষ্টির অদ্ভুত এক ঘেরাটোপে নিজেদে বয়স বাড়ান।
অপরপক্ষে কম বয়সে রচিত লেখাকে কিংবা প্রাপ্ত বয়সেরও অনেক রচনাকে যারা মূল্যহীন জ্ঞান করেন এবং নিজের লেখাকে পরিবর্তিত ও ঋদ্ধ করতে চান, কিছুটা হয়তো করতে পারেনও তারাই উত্তরকালের শ্রদ্ধেয় বিবেচিত হন।
সৃজনশীলতা চিরকাল জঙ্গমতাকে লালন করে। অনেকেই ষাটোর্ধ্ব বয়সে লিখতে পারলেই খুশি হন। কিন্তু লেখালেখিতে সচলতাই মুখ্য নয়। বিষয়বস্তু, ভাষাব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি, উপস্থাপনরীতি- অন্তত এর যে কোনো একটি ক্ষেত্রে সজীব সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন আছে।
এবং এ সবকিছুর সঙ্গেই প্রাগুক্ত ‘রুচি ও প্রগতি’ বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভেবে দেখুন, আব্দুল আলীমের গান কিংবা জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি বোঝার জন্য পাণ্ডিত্য না থাকলেও চলে। বিশ্লেষণনিরপেক্ষ মনের গূঢ় চৈতন্য স্তরে ওই বোধ জন্মে।