গত ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালটা ছিল নিউইয়র্ক পুলিশের সদর দপ্তরে একেবারেই আলাদা। সাধারণ দিনে যেখানকার পরিবেশ থাকে গম্ভীর আর কর্মব্যস্ত, সেদিন সেখানে ছিল একরাশ আনন্দ, প্রত্যাশা আর গর্বের ঝিলিক। কারণ—নিউইয়র্ক পুলিশের চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কর্মকর্তা সেদিন পেলেন পদোন্নতির স্বীকৃতি।
প্রধান অতিথি পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ যখন একে একে তাঁদের নাম ডাকলেন, গ্যালারিতে বসা বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটির লোকজন উঠে দাঁড়ালেন করতালিতে। মুহূর্তটা যেন কোনো এক উৎসবের দৃশ্য। সাফল্যের এই পদক্ষেপ কেবল চারজন কর্মকর্তার নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মিলিত স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠলো।
সবচেয়ে বেশি আলো কেড়েছেন ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হওয়া কারাম চৌধুরী। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ছেলে, যিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে এসেছিলেন আমেরিকায়। পরিবার তখন নতুন অভিবাসী—সংগ্রামের দিন, অভাবের দিন। সেই ছোট্ট ছেলেটি আজ নিউইয়র্ক পুলিশের ১০৪ প্রিসিঙ্কটের কমান্ডিং অফিসার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সার্টিফিকেট হাতে নেওয়ার সময় তাঁর মুখে গর্বের হাসি, আর চোখেমুখে যেন ভেসে উঠেছিল দীর্ঘ পথচলার কাহিনি।
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবু নূর মোহাম্মদ সৈয়দ। বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সুপারভাইজার, ছেলে আজ সার্জেন্ট। বাবা-ছেলের এই সাফল্যের মুহূর্তে চোখে জল এনেছিল অনেকের। কারণ এটি কেবল পদোন্নতি নয়, এটি প্রথম প্রজন্মের সংগ্রাম আর দ্বিতীয় প্রজন্মের অর্জনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর গ্রাম থেকে উঠে আসা জসিম মিয়া আর সিলেটের রাজনগরের তুহিন খান—দুজনেই প্রমাণ করেছেন, পরিশ্রম আর সততা থাকলে প্রবাসে স্বপ্নও পূর্ণতা পায়। জসিম আজ সার্জেন্ট, আর তুহিনও নিউইয়র্ক পুলিশের এসআরজি ইউনিটে কাজের স্বীকৃতি নিয়ে সার্জেন্টের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। তাঁদের সাফল্য নতুন প্রজন্মকে সাহস জোগাবে।
বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)-এর সভাপতি এরশাদুর সিদ্দিক বললেন, “এটি আমাদের সবার বিজয়। এই অর্জন প্রমাণ করে আমরা সমাজে কেবল অংশগ্রহণই করছি না, নেতৃত্বও দিচ্ছি।” তাঁর কণ্ঠে ছিল গর্ব আর আবেগের মিশেল। পাশে ছিলেন ক্যাপ্টেন একেএম আলম, ভাইস প্রেসিডেন্ট আলী চৌধুরী ও সেক্রেটারি রাসেকুর মালিক। ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জানালেন, এই অর্জন প্রতিটি সদস্যকে অনুপ্রাণিত করবে—একদিন হয়তো আরও বেশি বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেবেন।
অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেল—প্রবাসী কমিউনিটির প্রবীণরা গর্বভরে বলছেন, “আজকে আমাদের সন্তানরা নিউইয়র্ক পুলিশের উঁচু পদে উঠছে। এ তো আমাদেরই বিজয়।” শিশুদের চোখে কৌতূহল—তারা দেখছে নতুন এক স্বপ্ন, যেটি তাদের জন্য পথ খুলে দিলো।
সেদিনের সকাল তাই শুধু একদল কর্মকর্তার পদোন্নতি ছিল না। এটি ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইতিহাসে আরেকটি উজ্জ্বল অধ্যায়—যা আগামী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে, কষ্টের দিনগুলো একদিন গর্বে রূপ নেয়।
এদিকে বাংলাদেশি-আমেরিকান কমিউনিটির গর্ব ইনস্পেক্টর খন্দকার আবদুল্লাহ গত সোমবার থেকে ব্রুকলিন নর্থ পেট্রোল বরোতে ইনস্পেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এই পদোন্নতির মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন এনওয়াইপিডিতে প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান যিনি এত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন।
ইনস্পেক্টর আবদুল্লাহ এর আগে দুটি সহিংসতা-প্রবণ থানার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর দক্ষতা ও দৃঢ় নেতৃত্বে উভয় এলাকায় অপরাধের হার ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে বেডস্টাই এলাকায় বছর বছর অপরাধ ও গুলির ঘটনা নেমে এসেছে ঐতিহাসিক নিম্নস্তরে। স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করে তিনি প্রমাণ করেছেন—অভিজ্ঞতা ও নিষ্ঠা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব।
এবার তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে পুরো বরোতে। বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে— “এটি শুধু ইনস্পেক্টর আবদুল্লাহর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য এক গৌরবের মুহূর্ত।”
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বাংলাদেশিদের সংগ্রামী যাত্রায় এই অর্জন নতুন আলোর দিশা দেখাচ্ছে। নিউইয়র্কের মতো বহুজাতিক মহানগরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ পদে একজন বাংলাদেশি-আমেরিকানের পদোন্নতি তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।