নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটি এখন ভাসছে উৎসবের জোয়ারে। চারদিকে হিড়িক পড়েছে বাহারি অনুষ্ঠান আয়োজনের। ছবিতে ছবিতে সয়লাব সোস্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেইসবুক। সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও পেশাজীবী সংগঠন ছাড়াও পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে রকমারি অনুষ্ঠানের ভারে কাঁপছে কমিউনিটি। গত রমজান মাস জুড়েই ইফতার পার্টিতে সরগরম ছিলো নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাগুলো। এরপর বসন্ত বাতাস ও পিঠা উৎসবে উন্মাতাল হয়ে উঠে একশ্রেনীর প্রবাসী বাংলাদেশী।
এসব অনুষ্ঠানে নাচ-গানের পাশাপাশি চলে ভোজন পর্ব। রমজানের পর থেকেই বিরামহীনভাবে চলছে ঈদ পুনর্মিলনী ও অন্যান্য অনুষ্ঠান। বিভিন্ন সংগঠন মেতে উঠেছে অভিষেক, সংবর্ধনা, বাংলা বর্ষবরণ সহ বৈশাখী পথমেলা আয়োজনে। আর এসব পথমেলা অব্যাহত থাকবে আগামী ভাদ্র আশ্বিন মাস পর্যন্ত।
বাংলা ছয় ঋতু কিংবা বারো মাসের নাম জানেন না এমন ব্যক্তিবর্গও ঘটা করে আয়োজন করছেন বৈশাখী মেলার। এছাড়াও নানাবিধ নামে পথমেলার আয়োজন চলছে কমিউনিটিতে। সম্প্রতি ব্রুকলীনের একটি পথমেলার বিগত প্রায় এক দশকের আয়-ব্যয় ও লাভ লোকশান নিয়ে আয়োজকদের মাঝে সৃষ্ট বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে কর্মকর্তাদের কর্মকান্ডের নেতিবাচবক সব সংবাদ।
বাংলা বর্ষবরণ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিবছরই যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। নিতান্ত ব্যক্তি সর্বস্ব একটি সংগঠন বাংলাদেশের কতিপয় ব্যাংক ও অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয়ে ম্যানহাটানের টাইমস স্কোয়ারে ঘটা করে আয়োজন করছে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সম্প্রতি প্রথমাবারের মতো বাংলাদেশী কমিউনিটির একশ্রেনীর নারীকে দেখা গেছে টাইম স্কোয়ারে শাড়ি প্যারেডে অংশ নিতে।
নিউইয়র্ক সিটির আর্থিক অনুদানে পরিচালিত কমিউনিটির দু’একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন বছর জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি করে থাকে। তাদের গৃহীত অনেক কর্মসূচী নিয়ে কমিউনিটিতে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিক থেকে।
এবার গ্রীষ্মের প্রারম্ভে আমুদে বাংলাদেশী কমিউনিটি ক্রমশই মেতে উঠছে আনন্দ উৎসবে। আগামী মাস থেকে শুরু হবে বনভোজন এবং তা চলবে অক্টোবর পর্যন্ত। কমিউনিটির প্রায় চার শতাধিক সংগঠন বিগত কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কে বনভোজনের আয়োজন করে গড়েছে বিশ্ব রেকর্ড। শুধুমাত্র বনভোজনেই বাংলাদেশীরা ব্যয় করে থাকেন কয়েক মিলিয়ন ডলার। শীতের শুরুতেই তারা রিজার্ভেশন দিয়ে থাকেন বনভোজনের স্থানগুলো। সম্ভবত: বনভোজনেই সবচেয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করে থাকেন বাংলাদেশীরা।
কমিউনিটিতে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় ও উৎসবের আমেজ সাধারণ প্রবাসীদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। জন্মদিন, গায়ে হলুদ, বিবাহ বার্ষিকী, গ্র্যাজুয়েশন প্রীতিভোজ চলছে প্রতিটি সপ্তাহান্তে। ফেইসবুক জীবন্ত রাখতে কেউ কেউ একাধিকবার জন্মদিন পালন করছে এমন খবরও চাউর আছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানই রূপ নিচ্ছে উৎসবে। ফেইসবুকে কে কতো ছবি সাঁটতে পারেন এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। একারণে সমাজে কদর বেড়েছে একশ্রেনীর ফটো গ্রাফারের। তাদের কেউ কেউ আবার পুরো অনুষ্ঠান লাইভ করছেন।
চলতি উৎসব মৌসুমে নিউইয়র্ক সিটির পার্টি হল, পার্ক সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্থল বুক হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। নিউইয়র্কে অন্য কোন দেশের প্রবাসীদের এতো সংখ্যক সংগঠন যেমন নেই, তেমনি নেই অহেতুক অনুষ্ঠান আয়োজনের বাতিক। অন্য ভাষাভাষী ও জাতি গোষ্ঠির মানুষের মাঝে এতো অর্থ ব্যয় ও কমিউনিটি লীডার হওয়ার অশুভ প্রতিযোগীতারও বালাই নেই। কমিউনিটিতে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজক, পৃষ্ঠপোষক ও দর্শক শ্রোতা খুবই সীমিত। ধারণা করা হয় নিউইয়র্ক সিটিতে তিন লাখের অধিক বাংলাদেশীর বসবাস। কিন্তু দু’চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক এবং দর্শক শ্রোতা সবার নিকট পরিচিত। তিন লাখ প্রবাসীর মাঝে হাতে গুণা শ’তিনেক মানুষ সাধারণত এসব উৎসব আয়োজনে অংশ নেন। বাকিদের নূন্যতম কোন সম্পৃক্ততা নেই এসব উৎসব আয়োজনে।
প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই কথিত মূলধারার রাজনীতির মুখ চেনা কয়েকজন স্থানীয় জন প্রতিনিধিকে হাজির করে গুণকীর্তন করা হয় তাদের। নতুন প্রজন্মের সন্তানদেরকে এসব অনুষ্ঠানে দেখা যায় না বললেই চলে। তাদেরকে উৎসাহিত করারও কোন উদ্যোগ নেই।
অথচ প্রতিটি অনুষ্ঠানে বয়ান দেয়া হয় বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও নতুন প্রজন্মের। তবে সম্প্রতি কমিউনিটির কতিপয় ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিউইয়র্ক সিটির শীর্ষ জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি প্রবাসীদের মাঝে কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে এবং বিষয়টি পরিণত হচ্ছে টক অব দ্যা টাউনে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিনব কিছু অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে কমিউনিটিতে। বিশেষ একটি মহল ‘ধর্ম যার যার-উৎসব সবার” শ্লোগান সামনে রেখে নানাবিধ ধর্মীয় উৎসবে আয়োজন করছে। প্রতিবেশী দেশের কনুস্যুলেট ও দূতাবাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের আনাগোনা। একই বছর এসএসসি পাশ করেছেন এবং ঢাকায় কোন এক মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন তারাও নতুন সংগঠন গড়ে আয়োজন করছেন উৎসবের। এসব বিলাসী উৎসব আয়োজনের ঢেউ লেগেছে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ কনস্যুলেট ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনেও। তারাও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে উৎসব আয়োজন করে বিশেষ একটি শ্রেনীকে তুষ্ট করছেন এবং বর্হি:প্রকাশ ঘটাচ্ছেন নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রতিভার।
নিইয়র্কের উৎসবে নতুন সংযোজন বাংলাদেশ ডে প্যারেড। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বিভেদ বিভক্তির সংকট ক্রমেই আরো গভীর হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে এক ধরণের শ্রেনী বৈষম্য। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা নেই এমনটি বলা যাবে না। ঈদুল ফিতরের পূর্বে জ্যামাইকার একটি সংগঠন খাদ্য বিতরণের ঘোষণা দিলে প্রচন্ড শীতে ১৫ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তা সংগ্রহ করতে দেখা যায় অনেক বাংলাদেশীকে। দুপুর দেড়টায় খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করতে পূর্বরাত ১০টায় লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বাংলাদেশীরা। এই ঘটনা ভিন্ন বার্তা দিয়েছে কমিউনিটিকে। সামাজিক সম্প্রীতি ও মানষিক বিনোদনের জন্য উৎসব আয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়।